Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
বেতবেড়িয়ার ঘরহারা-বাম

বাড়ি বদলে যায় সইদুলদের

টিনের চালাটা যেন বছরের প্রথম ঝড়ের অপেক্ষায় রয়েছে। বাতাসে গুঞ্জন উঠলেই উড়ে যাবে। অজস্র ফুটো, ইতি-উতি তা চাপা দেওয়ার অক্ষম চেষ্টা। চাপড়ার কাঁঠালতলায় দশ বাই দশের এক চিলতে ঘরে সইদুল শেখের ঠিকানা।

সইদুল শেখ এবং মরিচা বিবি

সইদুল শেখ এবং মরিচা বিবি

সুস্মিত হালদার
চাপড়া শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৭ ১৩:২২
Share: Save:

টিনের চালাটা যেন বছরের প্রথম ঝড়ের অপেক্ষায় রয়েছে। বাতাসে গুঞ্জন উঠলেই উড়ে যাবে।

অজস্র ফুটো, ইতি-উতি তা চাপা দেওয়ার অক্ষম চেষ্টা। চাপড়ার কাঁঠালতলায় দশ বাই দশের এক চিলতে ঘরে সইদুল শেখের ঠিকানা।

তবে, সেই হত দরিদ্র সেই আস্তানাও সইদুলের নিজের নয়। জনা বিবি কিঞ্চিৎ অনুকম্পা নিয়েই আশ্রয়টুকু ছেড়ে দিয়েছেন তাঁদের।

আত্মীয় নন, পূর্ব পরিচয় ছিল এমনও নয়, জনা বলছেন, ‘‘মাস ছয়েক আগে, রাস্তার ধারে কাঁদতে দেখে সইদুলের পরিবারটাকে তুলে এনেছিলাম। তা, আমারও তো এই দসা এখানেই কোনও মতে মাথা গুঁজে রয়েছে।’’

বিল আর প্রায় জলহীন জলঙ্গিতে মাছ ধরে কোন মতে স্বামী-স্ত্রীর অন্ন সংস্থান। ছেলের পড়াশুনো শেষ বছর কয়েক আগে। সেই যবে ভাইয়ের খুনের পর রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। সেই ছেলে কাজের খোঁজে এখন মুম্বই। হোটেলে কাজ করে।

চার বছর আগের গ্রাম-বাড়ি-গরু, সাইদুলের এখনও মনে পড়ে খেত ভরা ফসল, গোলা ভরা ধানের বিকেল বেলা। সইদুল বলেন, ‘‘দিনের বেলা আশাদুলকে কুপিয়ে খুন করল, তার পরেই বাড়িতে আগুন ধরাল। পালিয়ে গেলাম।’’

সইদুল একা নন, সদ্য ক্ষমতায় আসা তৃণমূলের ‘হানা’য় সিপিএমের প্রায় শ’দেড়েক পরিবার সেই থেকে বেতবেড়িয়া ছাড়া। সইদুল বলছেন, ‘‘আমাদের অপরাধ, সিপিএম করি!’’

শুধু আসাদুল খুন নয়, ঘর-গোলা-খামারের গরু পুড়িয়ে তছনছ করার পরে লুঠপাটও কম হয়নি। বেতবেড়িয়ার হৃদয়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের স্বামী আশরফ শেখ, তৃণমূলের চাপড়া ব্লক কমিটির কার্যকরি সভাপতি শুকদেব ব্রক্ষ্ম— তৃণমূলের তাবড় নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগও হয়েছিল। তবে, জল গড়ায়নি। একে একে পেরিয়ে গেছে, লোকসভা, বিধানসভা নির্বাচন। ভোটের মুখে ফি বারই তাদের ঘরে ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে সইদুলেরা বলছেন, ‘‘সবই কাতায় কলমে। যাঁরা পিরেছিল, তাঁদের মুচলেকা দিয়ে সিপিএম ছাড়তে হয়েছে।’’

তাদের অভিযোগ, আশরফ শেখ ও তার বাহিনী গ্রামে ঢুকতে দেওয়া তো দূরের কথা তাদের চাষের জমি দখল করে নিয়েছে। কোথাও চাষ করছে তো কোথাও মাটি কেটে বিক্রি করে দিচ্ছে ইট ভাটায়। ফলে গ্রামে ফিরেও তাদের দিনযাপন কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

সইদুলের এগারো ভাইযের পরিবার এখন ছডিয়ে ছিটিয়ে গিয়েছে। জান্দার শেখ আর তার ছেলে এখন মুম্বইয়ে। বিয়ে হয়ে গিয়েছে দুই মেয়ের। ছোট দুই মেয়েকে বোনের বাড়িতে রেখে এখন বিভিন্ন আত্মীয়ের বাড়িতে দিন দশেক করে ছন্নছাড়া দিনযাপন স্ত্রী মরিচা বিবির। মরিচা বিবি বলেন, “আজ আমার কোন আশ্রয় নেই। যাযাবর হয়ে গেছি গো!’’

তেহট্টের তরণীপুরে মামার বাড়িতে কিছু দিন থাকার পরে মঙ্গলবার চাপড়ায় ভাশুর রমজান শেখের বাড়িতে এসে উঠেছেন মরিচা। এই রমজান শেখের প্রায় ১০ বিঘা জমি আছে বেতবেড়িয়ায়। সঙ্গে পাকা বাড়ি। এথন তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্লাস্টিকের জিনিস ফেরি করেন। বারশো টাকায় ঘর ভাড়া করে আছেন পরিবার নিয়ে। বড় ছেলে গিয়েছে মুম্বই। বাকিরা কেউ আছেন হাঁটরা, কেউ বাদলাঙ্গি, কেউ আবার তেহট্টের ভিটরপাড়া। আত্মীয়ের বাড়ি পরাশ্রয়ীর মতো। তবে এ সবের মধ্য সবচাইতে করুণ অবস্থা নিহত আসাদুলের পরিবারের। ছোট তিন সন্তানকে নিয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন বাঙ্গালঝি এলাকায়। তাকেও সন্তানদের নিয়ে রাস্তায় বসে কাঁদতে দেখে আশ্রয় দিয়েছিলেন পেশায় রাজমিস্ত্রী কাশেম শেখ। এখটা ছোট্ট মুগির খাঁচার মত ঘরে তিন সন্তানকে নিয়ে দিন কাটে তাঁর।

আসাদুল বলছেন, ‘‘আমাদের বেতবেড়িয়া গ্রামটা যেন টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে।’’

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CPM Workers Homeless
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE