Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মসলিনে ম্যাজিক বুনবে সুতো

পরলে মনে হয় যেন ছায়াই জড়িয়ে রয়েছে শরীরে। বাংলার তাঁতিদের হাতে তৈরি মসলিন তাই এককালে পরতেন রোমের সুন্দরীরা। সিল্ক রুটে চিনের রেশমের যেমন চাহিদা থাকত, তেমনই দাম পেত মসলিন।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৬ ০০:২২
Share: Save:

পরলে মনে হয় যেন ছায়াই জড়িয়ে রয়েছে শরীরে। বাংলার তাঁতিদের হাতে তৈরি মসলিন তাই এককালে পরতেন রোমের সুন্দরীরা। সিল্ক রুটে চিনের রেশমের যেমন চাহিদা থাকত, তেমনই দাম পেত মসলিন।

মসলিনের খ্যাতি অবশ্য সব থেকে বেশি ছড়ায় মুঘল আমলে। শোনা যায়, সাতটি মসলিন শাড়ি একের পর এক অঙ্গে ধারণ করে দরবারে এসেছিলেন নূরজাহান। কিন্তু তাতেও তাঁকে ‘বেশরম’ বলেছিলেন জাঁহাপনা জাহাঙ্গির।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় অদৃশ্য সেই মসলিনের উৎপাদন হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আবার সে এসেছে ফিরিয়া। নদিয়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ-সহ রাজ্যের মোট সাতটি জেলায় নতুন করে ফিরে এসেছে মসলিন। সম্ভব হয়েছে এমন সূক্ষ্ম ৫০০ কাউন্টের মসলিন বস্ত্র উৎপাদন করা, যা প্রচলিত গল্পের মতোই একটি আংটির মধ্যে দিয়ে গলে যায়। বহু মানুষ নতুন করে যুক্ত হয়েছেন মসলিন উৎপাদনের সঙ্গে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের বাজারেও দিন দিন চাহিদা বাড়ছে মসলিনের।

নবদ্বীপের মাটিয়ারি কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান এই মুহূর্তে সূক্ষ্ম মসলিন উৎপাদনে রাজ্যের অন্যতম অগ্রণী কেন্দ্র। মসলিনকে আরও সূক্ষ্ম করে তোলার জন্য নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছেন এই প্রতিষ্ঠানের সুতো কাটুনি থেকে বুনন শিল্পীরা। সেই কাজে ফের সাফল্য পেলেন তাঁরা। এত দিন পর্যন্ত সবচেয়ে সূক্ষ্ম মসলিন সুতো বলতে ৫০০ কাউন্টকেই ধরা হত। চেষ্টা হচ্ছিল, আরও সূক্ষ্ম সুতো উৎপাদনের। কয়েক বছরের ধারাবাহিক চেষ্টার পর অবশেষে সাফল্য এল। নবদ্বীপ মাটিয়ারী কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাটুনিরা ৫৫০ কাউন্টের মসলিন সুতো উৎপাদনে সফল হলেন। প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক শুভাশিস চক্রবর্তীর দাবি, “এই মুহূর্তে এ রাজ্যে তাপসীদেবীই একমাত্র সাড়ে পাঁচশো কাউন্টের মসলিন সুতো কাটতে পারেন।”

তারই স্বীকৃতি স্বরূপ গত ১৮ অক্টোবর চণ্ডীগড়ে পাঞ্জাব এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাপসী ঘোষকে সাড়ে পাঁচশো কাউন্টের মসলিন সুতো উৎপাদনের জন্য পুরস্কৃত করেছেন। ভারত সরকারের মাইক্রো স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইস মন্ত্রকের অধীন খাদিবোর্ডের তত্ত্বাবধানে নবদ্বীপের এই প্রতিষ্ঠান ১৯৮১ সাল থেকে মসলিন নিয়ে কাজ করে চলেছে। এই প্রতিষ্ঠানের তিরিশ জন কাটুনি এবং দশ জন মসলিন বয়ন শিল্পী ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে রাজ্য এবং সর্বভারতীয় স্তরে একাধিক বার পুরস্কৃত হয়েছেন।

শুভাশিসবাবু বলেন, “৫০০ কাউন্টেই থেমে থাকতে চাইনি আমরা। সাড়ে পাঁচশো কাউন্টের পর আমরা ৬০০ কাউন্টের সুতো তৈরির ব্যাপারেও অনেক দুর এগিয়ে গিয়েছি।” তিনি জানিয়েছেন, সমস্যা তুলো নিয়ে। কেবল সুভিন কাপাসের লম্বা আঁশ ছাড়া আর কোন তুলোয় মসলিন সুতো হয় না। দক্ষিণ ভারতের সালেম একমাত্র জায়গা, যেখানে এই তুলো উৎপন্ন হয়। ইদানিং বড় বড় কাপড় মিল ওই সুভিন কাপাস কিনে নিচ্ছে অনেক দাম দিয়ে। ফলে বাণিজ্যিক ভাবে ৬০০ কাউন্টের মসলিন তৈরি করতে সমস্যায় পড়ছেন তাঁরা।

কী বিশেষত্ব সাড়ে পাঁচশো কাউন্ট সুতোর? শুভাশিস জানান, একলাছি মানে এক হাজার মিটার পাঁচশো কাউন্ট মসলিন সুতোর ওজন ২ গ্রাম। সেখানে সাড়ে পাঁচশো কাঊণ্টের ওজন ১.৮ গ্রাম মাত্র। মাটিয়ারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিশেষ অম্বর চরকায় মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম মসলিন সুতোয় বোনা হচ্ছে নতুন স্বপ্ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

muslin yarn Demand increase
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE