সন্ধ্যায় ছিল ইলশেগুড়ি। রাতে ঝেঁপে নামল। সকালেও রেহাই নেই। ঝরছে তো ঝরেই চলেছে।
শিক বের করা ছাতা বন্ধ করে মায়াপুরের আয়ুব মণ্ডলের চায়ের দোকানে ঢুকে ইজাজ মিস্ত্রি গজগজ করছেন, ‘‘দিনটা খামোখা মাটি হল।’’ বাঁশের পাটাতনে বসে একটা কড়া দুধ-চায়ের ‘অর্ডার’ দিয়ে ইজাজ বিড়বিড় করছেন, ‘‘কাল গেরস্তের হেঁশেলটা অর্ধেক ভেঙে এসেছি। আজ শেষ করব ভেবেছিলাম। সে আর হল কই! হতচ্ছাড়া বৃষ্টি সব বরবাদ করে দিল।’’
এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন চায়ের দোকানদার আয়ুব। তিনি নিজেও এক সময়ে ইজাজের মতোই রাজমিস্ত্রি ছিলেন। বয়সের ভারে এখন চায়ের দোকান খুলে বসেছেন। তাঁর দোকানে চায়ের সঙ্গে টা থাকুক বা না থাকুক গপ্পের কমতি নেই। লোকে বলে, এমন কোনও বিষয় ভূ-ভারতে নেই যা নিয়ে আয়ুব চাচার ঝুলিতে গপ্প নেই। সাত-সকালে হেঁশেল ভাঙার কথা উঠতেই চাচার হাতটা যেন ঈষৎ কেঁপে গেল। চলকে বেশ কিছুটা চা গেলাস থেকে পড়ল মাটিতে। চাচা সভয়ে বললেন, ‘‘দেখো ইজাজ, সাবধানে। হেঁশেল ভাঙা বড় কঠিন কাজ বাপু। সব হেঁশেল আবার ভাঙাও যায় না।”
চাচার কথায় গপ্পের গন্ধ। দোকানে জমাট ভিড়টা ততক্ষণে ছেঁকে ধরেছে, ‘‘ঝেড়ে কাশো তো চাচা। সব হেঁশেল ভাঙা যায় না— কথাটার মানে কী?’’
প্রবল বৃষ্টিতে বাইরে তখন সব ঝাপসা। দোকানে গিজগিজ করছে কাজ কামাই হওয়া রাজমিস্ত্রি, জোগাড়েরা। তাঁদের হাতে চায়ের গেলাস ধরিয়ে আয়ুব চাচা বলেন, ‘‘সে এক আজব ঘটনা। আমার জীবনে অমন ঘটনা এক বারই ঘটেছিল। উফ্, এখনও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়।’’
নিজেও চায়ের গেলাসে চুমক দিয়ে চাচা শুরু করেন— ‘সে অনেক বছর আগের কথা। নবদ্বীপে একটা পুরনো মন্দির মেরামত করা হচ্ছিল। সে দিন কাজ হচ্ছিল মন্দিরের ভোগ-রান্নার ঘরে। বিরাট ঘরের এক দিকে ছিল চারটে পাকা উনুন। সেগুলোই ভাঙা হচ্ছিল। প্রথম তিনটে ভাঙা হয়ে গিয়েছে। আমি একটু জিরিয়ে চার নম্বরটা ভাঙব বলে উনুনের মধ্যে নেমে সবে শাবল দিয়ে এক ঘা দিয়েছি। হঠাৎ মনে হল কে যেন উনুনের ভিতর থেকে আমার পা টেনে ধরেছে। প্রথমে ভাবলাম হয়তো দড়িটরি কিছুতে জড়িয়ে গেছে। উনুনের গর্তে তাকিয়ে কিছু দেখতে পেলাম না। কিন্তু দ্বিতীয় ঘা মারতেই একেবারে হ্যাঁচকা টান। হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। একটুর জন্য শাবলের খোঁচা থেকে চোখটা বাঁচল। সে দিনও এমন ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছিল। একে পুরানো মন্দির। ভাঙাচোরা। চারদিকে ঝোপ-জঙ্গল। কেমন ভয় ধরল। কিছুক্ষণ পর অন্য এক মিস্ত্রি আমার কথা শুনে খুব হাসল। সে নিজে গিয়ে শাবল মারতেই সে কোপ গিয়ে লাগল তার নিজের নখে। সে দিন আর কাজ হয়নি।’
চায়ের দোকানে পিন পড়ার স্তব্ধতা। চা শেষ করে কেউ কেউ বিড়ি ধরিয়েছেন। চাচার চা জুড়িয়ে জল। সেটাই এক চুমুকে শেষ করে চাচা ফের শুরু করেন, ‘বাড়ি ফিরে সন্ধ্যার পরে জ্বর এল। শরীরে কেমন যেন অস্বস্তি। রাতে ঘুম এল না কিছুতেই। ভোরের দিকে চোখটা লেগে গিয়েছিল। হঠাৎ দেখি, আমি সেই মন্দিরের পিছনের জঙ্গলে শুয়ে আছি। চারপাশে কারা যেন খুব রেগে গিয়ে কথা বলছে। মনে হল অনেকে আছে। ছায়ার মতো তারা সরে সরে যাচ্ছে। কথা বলার মতো ক্ষমতা নেই। কুলকুল করে ঘামছি। দম বন্ধ হয়ে আসছে। কানের কাছে মুখ নিয়ে সমস্বরে সেই ছায়ামূর্তিরা বলে চলেছে, ‘কীঁ রে, আমাদেঁর থাঁকার জায়গা আর ভাঙবি?’ তার পরে আর কিচ্ছু মনে নেই। পরে শুনেছি, জ্ঞান হারিয়ে চৌকি থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। সেই শব্দে বাড়ির লোকজন এসে চোখেমুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়েছিল। বেশ কয়েক দিন লেগেছিল সুস্থ হতে। আর ওখানে কাজ করতে যাইনি। পরে খবর পেয়েছি, ওই মন্দিরে অনেক কাজ হয়েছে। কিন্তু পুরনো একটা উনুন আজও থেকে গিয়েছে।’
লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাচা বলেন, ‘‘সেই কারণেই বলছিলাম ইজাজ, সব হেঁশেল ভাঙতে যেও না।’’ ফের এক বার শিউরে ওঠেন ইজাজ। বাইরে বৃষ্টি তখন ধরে এসেছে।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy