Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মন খারাপের পোস্টকার্ডে হোয়াটসঅ্যাপের পিঁপড়ে

টুং করে এটি শব্দ। জিয়াগঞ্জের আমাইপাড়া উদ্বাস্তু বিদ্যাপীঠের সত্তর ছুঁইছুঁই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সমীর ঘোষের স্মার্ট ফোনটা জ্বলজ্বল করে উঠল।

উদ্ধার হওয়া চার ছাত্র। — নিজস্ব চিত্র

উদ্ধার হওয়া চার ছাত্র। — নিজস্ব চিত্র

অনল আবেদিন
বহরমপুর শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৬ ০০:৪৩
Share: Save:

টুং করে এটি শব্দ।

জিয়াগঞ্জের আমাইপাড়া উদ্বাস্তু বিদ্যাপীঠের সত্তর ছুঁইছুঁই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সমীর ঘোষের স্মার্ট ফোনটা জ্বলজ্বল করে উঠল।

টুং মানেই নোটিফিকেশন। হোয়াটস অ্যাপ বা ফেসবুকে কিছু বার্তা এসেছে। খুলে দেখলেন, রকমারি মিষ্টি আর সঙ্গে লেখা ‘শুভ বিজয়া’।

হোয়াটস অ্যাপের ওয়ালে সেই ছবিটা দেখে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েন তিনি। টাইম মেশিনে চেপে তিনি পৌঁছে যান তাঁর কৈশোরে— পুজোর আগেই তিনি তাঁর দিদির হুকুম মত ডাকঘরে পৌঁছে যেতেন। বেশ কিছু পোস্টকার্ড ও খাম কিনে বাড়ি ফিরতেন। তখন সাকুল্যে দু’পয়সায় পোস্টকার্ড মিলত। খামের দাম ছিল পাঁচ পয়সা। দশমীর দিন থেকে লেখা শুরু হয়ে যেত বিজয়ার প্রণাম, স্নেহ, শুভেচ্ছার চিঠি।

সমীরবাবু বলেন, ‘‘এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে ২-৩ দিন ধরে বিজয়া করার জন্য আমাদের একটি দল ছিল। দল বেঁধে আমরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বড়দের প্রণাম করতাম। তাঁরা আমাদের কপালে চুমু খেয়ে কোচড় ভরে নাড়ু, মুড়ি, মুড়কি দিতেন।’’

সকাল থেকে দুপুর কেটে যাওয়া সময়টা এখনও ধরা আছে তাঁর স্মৃতিতে।

তার পর দিদির হয়ে দিদির ফরমাস মতো চিঠি লেখা, তা-ও তো ছিল। বিজয়ার চিঠি। তাতেই প্রণাম, তাতেই শুভেচ্ছা, তাতেই স্নেহ-ভালবাসা জানানো। তার পর কয়েক দিন ধরে পাল্টা শারদ-শুভেচ্ছা বহণ করে পোস্টকার্ড এসে ভরিয়ে দিত ডাক বাক্স।

ওড়িষার একটি সিমেন্ট কারখানার অফিসার ছিলেন তাঁর জামাইবাবু। তিনি পুজোয় আসতে পারতেন না। দিদি তাঁকেও চিঠি লিখে বিজয়ার প্রণাম সারতেন।

চক-ইসলামপুর শ্রীকৃষ্ণ চম্পালাল মাহেশ্বরী হাইস্কুলের গ্রন্থগারিকের দায়িত্ব থেকে সদ্য অবসর নিয়েছেন লোকসংস্কৃতি গবেষক দীপক বিশ্বাসের অভিজ্ঞতাও একইরকমের। তাঁর শৈশব কেটেছে নওদা থানা এলাকার সফদরনগর গ্রামে। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনকালের বিজয়ার সঙ্গে পোস্টকার্ড সংস্কৃতি ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত। এ বাডি, সে বাড়ি গিয়ে প্রণাম ও কোলাকুলি তো ছিলই। কিন্তু যাঁরা বহু দূরে থাকতেন তাঁদের জন্য হাতে লেখা চিঠিই ছিল এক মাত্র ভরসা।’’

দীপকবাবুর জ্যাঠামশায়, জেঠিমা থাকতেন কলকাতায়। দীপকবাবু বলেন, ‘‘আমার মা-বাবা পুজোর প্রণাম চিঠিতেই সারতেন। জ্যাঠামশায়, জেঠিমার কাছ থেকে বিজয়ার আশীর্বাদ পেতে বাড়িতে পোস্ট অফিসের পিওনের আগমনের দিকে চেয়ে থাকতেন বাবা-মা।’’ সেই চিঠি আদানপ্রদান নিয়ে বিজয়ার কয়েকদিন প্রতিবেশীদের মধ্যেও বেশ চর্চা ছিল। কার বাড়িতে চিঠি এসেছে, এলে কে কার কি খবর নিয়েছে, কার বাড়িতে আসেনি— দশমী অন্তে সেই প্লম্বিত চর্চা চলতই।

তারপর একে একে এল ফোন তারও পরে মোবাইল, আর এখন— প্রৌড়ের কপালে ভাঁজ পড়ে বিরক্তির।

এখন সেই প্রযুক্তির হাত ধরেই প্রণাম নেন ওঁরা। চিঠি হারিয়েছে, এখন ওই ফোনেই কেমন অভ্যস্থ হয়ে গেছেন তাঁরা। এ ভাবেই বুঝি অতীতের উঠোনে জাঁকিয়ে বসে বর্তমান।

সমীরবাবুর প্রয়াত স্ত্রীর দাদার বয়স আশি ছাড়িয়েছে। তিনি থাকেন দুর্গাপুরে। সমীরবাবু বলেন, ‘‘তাঁকে প্রতিবছর ফোনেই বিজয়ার প্রণাম জানাই। এ বার জানাতে দেরি হওয়ায় তিনি ক্ষুন্নও হয়েছেন।’’

টেলিফোন তো কোন ছাড়, স্মার্ট ফোনের দৌলতে এখন তো মহালয়া থেকে বিজয়া সবেরই ভরসা ওই সব উজ্জ্বল পোন। সমীরবাবু বলছেন, ‘‘হারানো ইনল্যান্ডের জায়গাটা তো ওই ফোনের দখলেই চলে গিয়েছে।’’

সঙ্গে রয়েছে রাবন নিধন, মহিষাসুর বধ, পুজো ও ঢাকের বাদ্যির ‘মুভি’, হাজার কিসিমের ছড়া
স্টিল ছবি।

হোয়াটস অ্যাপে উড়ে আসা তেমনই একটি পোস্ট মন ভাল করে দিয়েছে তাঁর— বিজয়ার সঙ্গে এ ভাবে মিস্টি পাঠাবেন না প্লিজ। মোবাইলে পিঁপড়ের পাল ঢুকে পড়ছে।

সমীরবাবু বলেন, ‘‘বড় মন খারাপ হয়ে গেল জানেন, সেই সব পিঁপড়ে মাখা মিষ্টি, এখন তো সবে ফ্রিজের দেরাজ-বন্দি পিঁপড়ে হবে কী করে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE