ছেলেমেয়েগুলোর শুকনো মুখ, বড়ই শুকনো। তাদের আটপৌরে ঘর-বাড়িতেও তেমনই অখুশির ছায়া।
তাদের বাবা’রা অধিকাংশই ‘ভিনদেশ’এ রাজমিস্ত্রি কেউ জোগাড়ে, আর না হয় জরির কাজে গুজরাতের প্রান্তিক শহরে। হাড়ভাঙা খাটুনির পরে দিনান্তে মায়ের দেখা মেলে ঠিকই, স্নেহ নয়।
এই অনাদরের ঘেরাটোপে, কঠিন বাস্তবে, গান-ছবি আঁকা-নাটক? সীমান্ত ছোঁয়া জনপদ লালগোলার লস্করপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গির আলম হাঁ হাঁ করে উঠছেন, ‘‘ও সবের সঙ্গে কোনও সংশ্রবই ছিল না ওদের। আর এখন ছেলেপুলেগুলোর সেই সুপ্ত ক্ষমতাগুলোই বাইরে টেনে আনার চেষ্টা করছি আমরা।’’
স্কুল-ছুট রুখতে তাই গান-ছবি-নাটকের জগতে তাদের ফিরিয়ে দিয়ে স্কুলমুখো করাই জাহাঙ্গিরের লক্ষ্য। স্কুল ফুরোতেই আঁকা-গান-আবৃত্তি শেখানোর ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষকেরা। তল্লাটের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিম সম্প্রদায়ের। অধিকাংশের বাবা-দাদারা রাজমিস্ত্রি কিংবা জোগাড়ের কাজে বছরের প্রায় এগারো মাসই বাড়ির বাইরে, সুদূরে। সেই সব পরিবারের ছেলেমেয়েরাই লস্করপুর হাইস্কুলের পড়ুয়া। স্কুলের বয়স প্রায় ৪৮ বছর। ধীরে ধীরে বেড়েছে পড়ুয়া, এখন প্রায় হাজার তিনেক।
বছর পাঁচেক আগে ওই স্কুলের প্রধানশিক্ষকের চেয়ারে বসে জাহাঙ্গির আলম দেখেন, পাশ-ফেল না থাকার কারণে অধিকাংশ পড়ুয়াই বর্ণপরিচয় ও ধারাপাত ঠিক মতো না শিখেই অষ্টম শ্রেণি পাশ করে গিয়েছে। জাহাঙ্গির বলেন, ‘‘ফলে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে বর্ণপরিচয় ও ধারাপাত শেখাতে গিয়ে মনে হল এই সব শিশুদের মধ্যেও তো আঁকা, আবৃত্তি ও গানের মতো প্রতিভা লুকিয়ে থাকতে পারে।’’ চেষ্টাটা তখন থেকেই।
সহকারি প্রধানশিক্ষক মহম্মদ শামিম বলেন, ‘‘প্রতি দিন টিফিনের সময় গানের ক্লাস হয়। শুক্রবারের টিফিন এক ঘণ্টা দশ মিনিট। ওই সময় আবৃত্তির ক্লাস।’’ আর সেই গান-আবৃত্তির টানেই ফের ভরে উঠেছে স্কুল। স্কুল-ছুটের বদলে ফের স্কুল খোলার আগেই গেটের মুখে হামলে পড়া ভিড়।
ইটভাটার কর্মী সোনারুন্দি শেখের ছেলে, নবম শ্রেণির সারওয়ার জাহান গান ও আবৃত্তি শেখে। খোসালপুরের রাজমিস্ত্রি মইনুদ্দিনের মেয়ে, অষ্টম শ্রেণির তামান্নার আঁকার হাতটা বড় মিষ্টি। সোনারুন্দি বলছেন, ‘‘কে জানত বলুন তো আমার ছেলেটাক অমন মিঠে গলা!’’
বছরে এক বার তিনিও ঘরে ফেরেন ছেলের গান শুনবেন বলে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy