Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

হরিণঘাটায় হুমকি, কল্যাণীতে নিজেরই পরীক্ষা নিচ্ছে তৃণমূল

বড় জাগুলিয়ার মোড়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে বিজেপি কার্যালয়। শনিবার সেই অফিসের সামনে মোটরবাইক থামিয়ে হুড়মুড় করে ঢোকেন ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের দলীয় প্রার্থী অজামিন দাস। দলের নেতাদের বলেন, ‘‘আমি আবার চললাম। এলাকায় থাকলে বাড়িতে আগুন দেবে, আমায় খুন করবে বলে তৃণমূল হুমকি দিয়েছে।’’ শুনে দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তারক সরকার মাথা নেড়ে বলেন, ‘‘আচ্ছা।’’

সুস্মিত হালদার ও সৌমিত্র সিকদার
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৫ ০১:৪৯
Share: Save:

বড় জাগুলিয়ার মোড়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে বিজেপি কার্যালয়। শনিবার সেই অফিসের সামনে মোটরবাইক থামিয়ে হুড়মুড় করে ঢোকেন ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের দলীয় প্রার্থী অজামিন দাস। দলের নেতাদের বলেন, ‘‘আমি আবার চললাম। এলাকায় থাকলে বাড়িতে আগুন দেবে, আমায় খুন করবে বলে তৃণমূল হুমকি দিয়েছে।’’ শুনে দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তারক সরকার মাথা নেড়ে বলেন, ‘‘আচ্ছা।’’

যেখানে জনভিত্তি দুর্বল, সেখানে সন্ত্রাস করে বিরোধীদের কোণঠাসা করার চেষ্টা শাসকদল আগেও করত, এখনও করে। এর আগে বাম আমলে যা হয়েছে, তৃণমূলের আমলেও তার কোনও ব্যত্যয় হচ্ছে না।

এর অন্যতম উদাহরণ হিসেবে গণ্য হতে পারে নদিয়ার হরিণঘাটা। সেখানে সদ্য উপনির্বাচনে পুরসভার ১৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে আটটিতে সিপিএম এবং চারটিতে বিজেপি এগিয়ে ছিল। সেই হিসেব ধরলে তৃণমূল পাঁচটির বেশি আসন পায় না। তাই যেন তেন প্রকারেণ পুরসভার দখল নিতে তৃণমূল সন্ত্রাসের রাস্তা নিয়েছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের।

হরিণঘাটায় ইতিমধ্যে সিপিএমের দু’জন এবং বিজেপির এক প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বিরোধীদের অভিযোগ, মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর থেকেই সন্ত্রাস শুরু করেছে শাসকদল। শুধু প্রার্থীরা নন, তাঁদের পরিবারকেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন মন্ত্রী বঙ্কিম ঘোষের দাবি, ‘‘তৃণমূল বুঝে গিয়েছে, মানুষ ভোট দিতে পারলে ওদের হার নিশ্চিত। তাই ওরা কোনও ঝুঁকি নিতে চাইছে না।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘রাতের অন্ধকারে দল বেঁধে আমাদের প্রার্থী ও কর্মীদের বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিচ্ছে তৃণমূলের লোকেরা। পোস্টার-ব্যানার ছিঁড়ে দিচ্ছে। প্রার্থীরা প্রচারে বেরোতে ভয় পাচ্ছেন। উপনির্বাচনে ১২টি আসনেই বিরোধীরা এগিয়ে, তাই ওরা মানুষকে সন্ত্রস্ত করে রাখতে চাইছে।’’

১৬ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থী আগেই প্রার্থিপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তৃণমূলের লড়াইটা কেবল বিজেপির সঙ্গে। সেই কারণেই তৃণমূল এখানে কোনও ঝুঁকি নিতে চাইছে না বলে বিজেপির দাবি। মনোনয়ন-পর্ব মেটা ইস্তক এলাকাছাড়া ছিলেন অজামিনবাবু। শনিবার ভোরে বাড়ি ফিরেছিলেন। কিন্তু সেই খবর পেয়েই সাতসকালে কিছু তৃণমূল কর্মী তাঁর বাড়িতে হানা দেয় বলে অভিযোগ। দলীয় কার্যালয় থেকেই ছেলেকে মোবাইলে ফোন করে বিপত্নীক অজামিনবাবু জানালেন, ‘‘আবার চলে যাচ্ছি। তোরও বাড়িতে ঢোকার দরকার নেই। ওরা বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।’’ তার পরেই ফের মোটরবাইকে স্টার্ট দিয়ে জাগুলিয়ার রাস্তায় মিলিয়ে গেলেন।

ওই সময়ে দলীয় কার্যালয়েই বসে ছিলেন ১০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী হিরন্ময় সানা এবং ১২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী, বছর পঁচাত্তরের নিত্যগোপাল দত্ত। প্রচারে বেরোবেন না? প্রায় ফুঁসে উঠে নিত্যগোপালবাবু দাবি করলেন, ‘‘প্রচার না করার শর্তে ওরা আমাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছে। আর প্রচার করবই বা কাকে নিয়ে? কর্মীরা সব ভয়ে ঘরে ঢুকে গিয়েছে।’’ হরিণঘাটায় বিজেপির সেনাপতি তারকবাবুর দাবি, ‘‘প্রতিনিয়ত খুনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ভোট করার থেকে প্রাণ বাঁচাতেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে!’’ তিনি জানান, গোড়ায় কয়েক জন প্রার্থীকে নিয়ে প্রচারে বেরিয়েছিলেন। তাঁর অভিযোগ, ‘‘কয়েকটা বাড়ি ঘোরার পরে তৃণমূলের বাইক বাহিনী আমাদের ঘিরে ধরে লাঠিসোটা, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মারমুখী হয়ে ওঠে। উপনির্বাচনের পরে ওরা পুরসভায় আমাদের দলের আহ্বায়কের বাড়িতে এমন বোমাবাজি করেছে যে তিনি আতঙ্কে আর বাড়ির বাইরে বেরোতে পারছেন না।’’

বিজেপি কার্যালয় থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে একটি চায়ের দোকানে তখন হালকা মেজাজে অনুগামীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ, হরিণঘাটায় তৃণমূলের সেনাপতি চঞ্চল দেবনাথ। কিছু দিন আগেও তিনি মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। শিবির বদলের পরে এখন তিনি ব্লক সভাপতি। সন্ত্রাসের অভিযোগ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিয়ে তাঁর পাল্টা— ‘‘বিরোধী কোথায় যে সন্ত্রাস করব? আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। কাউকে ভয় দেখানোর কোনও প্রশ্নই নেই। ওরা সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল তাই রাস্তায় দেখা যাচ্ছে না।’’

উপনির্বাচনের ফল তো বলছে না যে বিরোধীরা দুর্বল? চঞ্চলবাবুর দাবি, ‘‘উপনির্বাচনে এই পুরসভা এলাকায় আমরা প্রায় পাঁচশো ভোটে এগিয়ে আছি। কিন্তু সেটাও বড় কথা নয়। কারণ এ বারের ভোটে তার কেন প্রভাব পড়বে না। এটা আলাদা ভোট। আমাদের ভোট অনেক বাড়বে।’’ সত্যি বলতে, শহরের নানা এলাকায় ঘুরে বিক্ষিপ্ত ভাবে কয়েকটি জায়গায় সিপিএমের পতাকা ছাড়া বিরোধীদের কোনও অস্তিত্বই চোখে পড়েনি। কংগ্রেস ১১টি ওয়ার্ডে প্রার্থী দিলেও তাদের দুরবিন দিয়ে খুঁজতে হচ্ছে। কিন্তু সিপিএম আবার তাদের ভোট ধরে রাখার ব্যাপারে যথেষ্ট প্রত্যয়ী। সংগঠনের উপরে ভিত্তি করে তারা শেষ পর্যন্ত লড়াইটা দিতে চাইছে। ভয় দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেও বঙ্কিমবাবু বলেন, ‘‘আমাদের কর্মীরা শেষ পর্যন্ত লড়াই দিতে প্রস্তুত।’’ তিনি হিসেব কষছেন, হরিণঘাটা ১ ও ২ পঞ্চায়েত নিয়ে হরিণঘাটা পুরসভা তৈরি হয়েছে। হরিণঘাটা ১ পঞ্চায়েত সিপিএমের দখলে ছিল। বঙ্কিমবাবুর দাবি, ‘‘মানুষ ভোট দিতে পারলে কিন্তু আমরাই জিতব।’’

কিন্তু ভোট আদৌ দিতে পারবেন কি না, হরিণঘাটার বাসিন্দাদের একটা বড় অংশের তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। হরিণঘাটা বাজারে এক চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে চার দিকটা ভাল করে দেখে নিয়ে এক যুবক যেমন বলেন, ‘‘শেষ পর্যন্ত আমরা ভোটটা দিতে পারব তো? রাতের অন্ধকারে তৃণমূল যে ভাবে শাসিয়ে বেড়াচ্ছে, তাতে বিরোধীরা তো প্রচার করারই সাহস পাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ কোন সাহসে ভোট দিতে যাবেন?’’

এই পরিস্থিতির কিছুটা উল্টো চিত্র নদিয়ারই কল্যাণীতে। উপনির্বাচনে সেখনে ২১টি ওয়ার্ডের মধ্যে মোটে ৪টিতে পিছিয়ে তৃণমূল। ফলে সম্ভাব্য জয় নিয়ে তাদের বিশেষ সংশয় নেই। কিন্তু যে চারটিতে তারা পিছিয়ে ছিল, সেগুলিতে চোরাগোপ্তা শাসানি চলছে বলে কিছু মহলে অভিযোগ উঠছে। বিরোধীদের অভিযোগ, ১, ১৮ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কোথাও কোথাও সিপিএম বা বিজেপি নেতা-কর্মীদের প্রকাশ্যেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের প্রচারে বেরোতে নিষেধ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী গোড়াতেই মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। প্রাক্তন পুরপ্রধান, সিপিএম নেতা শান্তনু ঝায়ের দাবি, ‘‘তৃণমূলের সন্ত্রাসের কারণেই উনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। সর্বত্রই ওরা নীরব সন্ত্রাস করছে। ভোটারদেরও ভয় দেখাচ্ছে। তবে আমরা লড়াইটা ছাড়ব না।’’

২০ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী বিপ্লব দে আবার বেশ কিছু দিন ধরে এলাকাছাড়া। সমাজবিরোধী তকমা তাঁর গায়ে, পুলিশ তাঁকে খুঁজছে। তবে তাঁর বৃদ্ধা মা অঞ্জলি দে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। অঞ্জলিদেবীর দাবি, ‘‘ওরা আমার ছেলেকে প্রাণে মারতে চাইছে। আমাকেও বাধা দিচ্ছে। প্রচার করলে ছেলের চরম ক্ষতি করে দেবে বলে আমাকে হুমকি দিচ্ছে তৃণমূল।’’ বিজেপির জেলা সভাপতি কল্যাণ নন্দীর দাবি, ‘‘পুলিশের কাছে মিথ্যা অভিযোগ করে এলাকাছাড়া করা হয়েছে বিপ্লববাবুকে।’’

ঘটনা হল, কিছু দিন আগেও কল্যাণীতে তৃণমূলের ‘সম্পদ’ বলে পরিচিত বিপ্লববাবু। তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে ২০ নম্বর ও আশপাশের বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি হয়। উপনির্বাচনে ২০ নম্বরে এগিয়ে ছিল বিজেপি। পাশে ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে মাত্র ৩২ ভোটে এগিয়ে ছিল তৃণমূল। তিনি এলাকাছাড়া হওয়ায় শহরের বিজেপি কর্মীরাও কিছুটা হতাশ। কিন্তু দু’দিন আগে .যিনি ‘সম্পদ’ ছিলেন, তিনি রাতারাতি সমাজবিরোধী বনে গেলেন কী করে? তৃণমূলের কল্যাণী ব্লক সভাপতি অরুপ মুখোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘‘আমাদের দলেরই কেউ এক সময়ে এদের ডাস্টবিন থেকে তুলে এনেছিলেন। আজ আমরা আবার ওদের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি।’’ দলের কোন নেতার প্রতি এই ইঙ্গিত, তা তিনি ভাঙেননি। তবে ঘটনাচক্রে, কিছু দিন আগেও তিনি মুকুল-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। হাওয়ার বদল বুঝে আনুগত্য বদলেছেন, এখন তিনি দলের ব্লক সভাপতি।

তবে কিছু চাপা শাসানি বা পুলিশে মিথ্যা অভিযোগ দায়েরের ঘটনা যদি ঘটেও থাকে, সামগ্রিক ভাবে কল্যাণীর ছবিটা মোটেই তেমন আতঙ্কের নয়। স্থানীয় কে ডি মার্কেট এলাকার এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘এই শহরে প্রকাশ্যে সন্ত্রাস করাটা কঠিন। প্রচুর শিক্ষিত মানুষের বাস। এই নির্বাচনে সন্ত্রাস করলে আগামী বিধানসভা ভোটে তার ফল ভোগ করতে হবে শাসকদলকে। সেটা ওরা ভাল করেই জানে।’’

বরং বড় প্রশ্ন হল, মুকুল রায় ছাড়া কল্যাণীতে তৃণমূলের লড়াইটা কঠিন হবে না? অরুপবাবুর জবাব, ‘‘আমরা চাই না, এ বার জেলার বাইরে থেকে কেউ আসুক। আমরা নিজেরাই যে জিততে পারি, সেটা দেখিয়ে দেব।’’

বোঝা যায়, বিরোধীরা নয়, এ বার কল্যাণীতে তৃণমূলের আসল লড়াই সেই ছায়ার সঙ্গেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE