Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

রং-তুলিতে জীবন খোঁজে রানিনগরের টুটুল

মাস কয়েক আগে শীতের এক পড়ন্ত বিকেলে বইমেলার গেটের কাছে দাঁড়িয়েছিল ছিপছিপে চেহারার ছেলেটি। চোখদু’টো উজ্জ্বল হলেও চেহারায় অপুষ্টির ছাপ স্পষ্ট। বয়স বড়জোর তেরো কি চোদ্দো। হাতে একটা জীর্ণ নাইলনের ব্যাগ। পরনে তাপ্পি মারা সোয়েটার। ভয়ে ভয়ে আরও একটু এগিয়ে এসে গেটে দাঁড়িয়ে থাকা এক স্বেচ্ছাসেবীকে সে জিজ্ঞাসা করেছিল, “আমার কাছে পয়সা নেই। ছবি আঁকার জন্য এসেছি। ভিতরে যেতে দেবেন?”

নিজের ভুবনে মগ্ন টুটুল। বিশ্বজিৎ রাউতের তোলা ছবি।

নিজের ভুবনে মগ্ন টুটুল। বিশ্বজিৎ রাউতের তোলা ছবি।

সুজাউদ্দিন
ডোমকল শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৫ ০০:৩১
Share: Save:

মাস কয়েক আগে শীতের এক পড়ন্ত বিকেলে বইমেলার গেটের কাছে দাঁড়িয়েছিল ছিপছিপে চেহারার ছেলেটি। চোখদু’টো উজ্জ্বল হলেও চেহারায় অপুষ্টির ছাপ স্পষ্ট। বয়স বড়জোর তেরো কি চোদ্দো। হাতে একটা জীর্ণ নাইলনের ব্যাগ। পরনে তাপ্পি মারা সোয়েটার। ভয়ে ভয়ে আরও একটু এগিয়ে এসে গেটে দাঁড়িয়ে থাকা এক স্বেচ্ছাসেবীকে সে জিজ্ঞাসা করেছিল, “আমার কাছে পয়সা নেই। ছবি আঁকার জন্য এসেছি। ভিতরে যেতে দেবেন?”

দু’টাকার টিকিট হাতে না থাকায় প্রথমে অবশ্য একটু ইতস্তত করছিলেন ডোমকল বইমেলা কমিটির ওই স্বেচ্ছাসেবক। পরে তেলচিটে নাইলন ব্যাগে রং-পেনসিল আর একটুকরো সাদা কাগজ দেখে শেষ পর্যন্ত বইমেলা প্রাঙ্গণে ঢোকার অনুমতি পেয়েছিল প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূর থেকে উজিয়ে আসা রানিনগর হাই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র টুটুল শেখ। ছবি আঁকার প্রতি টুটুলের এমন আগ্রহ ও নিষ্ঠা দেখে প্রতিযোগিতার শেষে বইমেলা কমিটির কাছে দরবার করেছিল অন্য কচিকাঁচারা। তাঁরা জানিয়ে দিয়েছিল, “স্যার, আমাদের পুরস্কারের দরকার নেই। কিন্তু টুটুলের জন্য কিছু একটা করুন।”

শুধু বইমেলা কমিটি নয়, ছবি নিয়ে টুটুলের লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছিলেন ডোমকলের অনেকেই। পুরস্কার হিসাবে পাওয়া রং-পেনসিল, রং-তুলি, ছবি আঁকার খাতা, বই, নতুন জামাকাপড় হাতে খুশিতে কেঁদে ফেলেছিল ওই কিশোর। জীবনে প্রথম পুরস্কার পেয়েও চোখে জল কেন? লাজুক ছেলেটি কাঁপাকাঁপা গলায় বলেছিল, “এগুলো রাখব কোথায়! রেগে গিয়ে আমার আঁকা সব ছবি মা পুড়িয়ে দিয়েছে। ছবি এঁকেছি শুনলে বাবা যদি ফের লাঠি নিয়ে তাড়া করে!” রানিনগরের প্রত্যন্ত গ্রাম নজরানার টুটুলকে ওই তল্লাটের সকলেই চেনেন ছবি আঁকার সুবাদে। বাবা মোজাহার শেখ পেশায় মুড়ি বিক্রেতা। মা জৈতন বিবি গৃহবধূ। পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে দুই মেয়ে ও এক ছেলের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বাড়িতে মা বাবার সঙ্গে থাকে টুটুল ও তার এক ভাই। অভাবের সংসারে নুন আনতে ভাত ফুরোয়। ফলে ছেলের এই আঁকার নেশাকে বিলাসিতা বলেই মনে করে টুটুলের পরিবার।

কিন্তু টুটুলের ছবি আঁকার নেশা যে সেই ছেলেবেলা থেকেই। হামাগুড়ি দিতে দিতেই সে ধুলোয় আঁকিবুঁকি কাটত। স্কুলে পা রেখে বর্ণপরিচয়ের থেকেও তাঁর ঝোঁক বেশি ছিল স্লেটে নানা রকম দাগ কাটায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই নেশা বাড়তে থাকে। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে সে বাড়িতে আনতে শুরু করে আর্ট পেপার, রং-পেনসিল। তার বয়সী অন্য ছেলেরা যখন খেলাধুলায় ব্যস্ত তখন ঘরের মাদুরে বসে একমনে সাদা কাগজে টুটুল ফুটিয়ে তুলছে নীল আকাশ, পদ্মা নদী, পালতোলা নৌকো, হালধরা মাঝি। অভাবের সংসারে এসব ‘আদিখ্যেতা’ সহ্য হবে কেন! ছেলের মাথা থেকে ‘ছবি আঁকার ভূত’ তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন টুটুলের বাবা-মা। কখনও জুটেছে বেদম মার। কখনও ছাইপাঁশ বলে উনুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে টুটুলের আঁকা ছবি।

কিন্তু এত কিছুর পরেও ওই কিশোরকে দমানো যায়নি। পড়ার ফাঁকে সময় পেলেই সে ছবি আঁকে। সেই ছবিতে যেমন থাকে গাছপালা, প্রজাপতি, আকাশ, নদী, তেমনি থাকে চারপাশের নানা দৃশ্যও। সাইকেলে মুড়ি নিয়ে বাবার বাজারে যাওয়া কিংবা ছেঁড়া শাড়িতে মায়ের রান্না করার ছবিও টুটুল অনায়াসে ফুটিয়ে তোলে তার ছবির খাতায়। বাবা মোজাহার শেখ বলছেন, ‘‘সবাই বলে বটে যে ছেলে ভাল ছবি আঁকে। কিন্তু বলুন তো এ সব কি আমাদের সংসারে মানায়? ওই ছবির জন্য ওকে মারধরও তো কম করিনি। কিন্তু তাতেও কোনও ফল হয়নি। এখন আমিই হাল ছেড়ে দিয়েছি।”

টুটুলের আঁকা ছবি ঝোলানো আছে স্কুলের গ্রন্থাগারের দেওয়ালেও। গ্রন্থাগারিক আব্দুস সালাম বলেন, ‘‘স্কুলের ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় ও খাতা পেন নিয়েই বসে যেত আঁকতে। ওর ইচ্ছে দেখেই আমরা সামান্য কিছু রং-পেনসিল কিনে দিয়েছি। এখন থেকে আমরাও ওর জন্য কিছু করার চেষ্টা করব।’’ রানিনগর হাই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘‘টুটুল আমাদের স্কুলের গর্ব। ওর ছবির আঁকার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা এ বার আমরাই করব।” ডোমকলের একটি বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মেহেবুব আলম বলেন, ‘‘ছেলেটির অঙ্কন শিক্ষার পুরোপুরি দায়িত্ব নিতে রাজি। পাশাপাশি অন্য কোনও সাহায্য লাগলেও আমরা করব।”

আঁকার জন্য কোনও শিক্ষক তো দূরের কথা সময়ে রং-তুলিটুকুও জোটে না। তবুও হাল ছাড়েনি টুটুল। গাছের সরু ডাল দিয়ে তুলি, পুঁই বীজ থেঁতলে রং তৈরী করেও সে ছবি এঁকে চলেছে। বাধা রয়েছে পদে পদে। তারপরেও ওই কিশোর অনাবিল হাসতে পারে। বলতে পারে, “একটি ছবি শেষ হলে যে কী ভাল লাগে তা বলে বোঝাতে পারব না। সেই ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় আরও একটা ছবির জন্য এরকম অনেক অনেক কষ্ট সহ্য করা যায়।”

রান্না ফেলে ছেলের পাশে এসে বসেন জৈতন বিবি। হলুদ মাখা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, “ছবিই যেন ওর জান। আমি তো একবার রেগে গিয়ে ওর সব ছবি ভাতের উনুনে দিয়ে দিয়েছিলাম। পরে বুঝতে পেরেছি কাজটা ঠিক হয়নি। এখন আর কিছু বলি না। ছবি এঁকেই যদি ও ভাল থাকে তাহলে থাক।” টুটুলের চোখ এবার মায়ের দিকে, একবার আঁকার খাতায়। রং-পেনসিলে সে ফুটিয়ে তোলে মায়ের মুখ, বলিরেখা, চোখের নীচের ক্লান্তির ছাপ, হলুদ মাখা আটপৌরে শাড়ির আঁচল। জৈতন বিবি উঠে দাঁড়াতেই টুটুল বলে ওঠে, “আর একটু বোসো। একদম নড়বে না। মুখটা আর একটু বাঁ দিকে ঘোরাও। হ্যাঁ, এই ভাবে।” হাসতে হাসতে জৈতন বিবি বলেন, “দেখেছেন, পাগলা ছেলের কাণ্ড!”

চারপাশের এত বাধা, অশান্তি, লড়াই, হিংসা উপেক্ষা করে টুটুল একমনে ছবি এঁকে চলে। ছবির মধ্যে দিয়েই সে খুঁজে পেতে চায় জীবনের মানে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE