Advertisement
E-Paper

দাদাঠাকুরকে ভুলেছে তাঁর জঙ্গিপুর

রসিক দাদাঠাকুরকে বেমালুম ভুলেছে তাঁর নানা কর্মকাণ্ডের নিকটতম সাক্ষী জঙ্গিপুর-ই। সদ্য শেষ হওয়া পুরভোটে কোনও দলই দেওয়াল রাঙায়নি তাঁর ‘ভোট-কীর্তনে’র কৌতুক থেকে। ভোটের উত্তেজনার মাঝে এ বারও নিঃশব্দে চলে গিয়েছে তাঁর জন্ম-ম়ৃত্যু দিবস (দু’টিই ১৩ বৈশাখ)। এই বিশেষ দিনটিতে শহরের কোথাও স্মরণ-অনুষ্ঠান নজরে আসেনি। বাড়ির ছবিতে মালা চড়িয়ে দাদুকে স্মরণ করেছেন পরিজনেরাই।

বিমান হাজরা

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৫ ০১:৪১
অবহেলায় পড়ে দাদাঠাকুরের মূর্তি।

অবহেলায় পড়ে দাদাঠাকুরের মূর্তি।

রসিক দাদাঠাকুরকে বেমালুম ভুলেছে তাঁর নানা কর্মকাণ্ডের নিকটতম সাক্ষী জঙ্গিপুর-ই। সদ্য শেষ হওয়া পুরভোটে কোনও দলই দেওয়াল রাঙায়নি তাঁর ‘ভোট-কীর্তনে’র কৌতুক থেকে। ভোটের উত্তেজনার মাঝে এ বারও নিঃশব্দে চলে গিয়েছে তাঁর জন্ম-ম়ৃত্যু দিবস (দু’টিই ১৩ বৈশাখ)। এই বিশেষ দিনটিতে শহরের কোথাও স্মরণ-অনুষ্ঠান নজরে আসেনি। বাড়ির ছবিতে মালা চড়িয়ে দাদুকে স্মরণ করেছেন পরিজনেরাই।

দাদাঠাকুরের জীবদ্দশায় জীবনী-গ্রন্থ লিখে তাঁকে কিংবদন্তি করেছিলেন নলিনীকান্ত সরকার। দাদাঠাকুর চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের জন্যে পুরস্কৃত হয়েছিলেন অভিনেতা ছবি বিশ্বাস। অথচ, সামিউল শেখ বা কবিতা সরকারের মত বহু পড়ুয়ার কাছে আজও অপরিচিত শতাব্দী ছুঁইছুঁই প্রাচীন সাপ্তাহিক ‘জঙ্গিপুর সংবাদের’ স্রষ্ট্রা!

নলিনীকান্ত সরকার-সহ সমসাময়িক সাহিত্যিকদের নানা লেখা থেকে জানা যায়, মাথা উঁচু করে বাঁচাই ছিল দাদাঠাকুরের আদর্শ। কখনও কারও দান তিনি গ্রহণ করেননি। নিজস্ব ঢঙে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হতেন তিনি। প্রলোভনের কাছে কখনও মাথা নত করেননি। সহজেই পদ্য তৈরি করে তাতে সুর বাঁধার সহজাত ক্ষমতা ছিল এই শিল্পীর। নানা প্রয়োজনে গ্রামের মানুষের রক্ষাকর্তাও ছিলেন তিনি। তাৎক্ষণিক বুদ্ধিতে তাঁর কাছে হার মানতে হত জমিদারকেও। বশে আনতে পারতেন ইংরেজকে।

নগ্ন পদ, হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, গায়ে জড়ানো সাদা চাদর, জুঁফো গোঁফ জোড়ার ঠিক উপরে মোটা কাঁচের চশমার সেই কিংবদন্তীকে ভোলা কী এতই সহজ? এর উত্তরটা আসলে ‘বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি’—এই মন্তব্যের মধ্যেই রয়েছে বলে মনে করেন বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক সাধন দাস। তাঁর মত, ‘‘ব্যর্থতাটা আসলে আমাদেরই। আমরাই ছেলেমেয়েদের তাঁর কথা জানাতে পারিনি। তা ছাড়া পাঠ্য বইগুলির কোথাও দাদাঠাকুরের কোনও রচনা নেই। কোথা থেকে ওরা অমন মানুষকে জানবে!’’

জঙ্গিপুর হাইস্কুল থেকে ১৯০০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছিলেন শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। পরে ‘দাদাঠাকুর’ নামের জনপ্রিয়তায় আড়ালে চলে যায় পিতৃদত্ত নামটি। ১২৮৮ সনের ১৩ বৈশাখ বীরভূমের ধরমপুরে তাঁর জন্ম। সেখান থেকে বীরভূমের সিমলান্দিতে মামার বাড়িতে বেশ কিছু দিন কাটিয়ে তিনি আসেন জঙ্গিপুরের পাশের গ্রাম দফরপুরে।

ছোটতেই বাবা হরিলাল পণ্ডিত মারা যাওয়ায় অকৃতদার কাকা ঈশানচন্দ্রের কাছেই থাকতেন তিনি। তাঁর ম্যাট্রিকুলেশন পাশের শংসাপত্রটি স্কুলে সযত্নে রাখা আছে।

প্রধান শিক্ষক ফারহাদ আলি জানালেন, তিনি আমাদের স্কুলের ছাত্র ছিলেন, এটা গর্বের। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘স্কুলে দু’একবার তাঁর স্মরণে অনুষ্ঠান হয়েছে। তা দিয়ে আর কতটুকু ওই মানুষকে চেনানো যায়। স্কুলের পাঠ্য বইতে তাঁর লেখা তুলে ধরলে কিছুটা উপকার হতে পারে।’’ শ্রীকান্তবাটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক উৎপল মণ্ডলের মত, কম্পিউটারের যুগে এমনতেই পড়ার বাইরের পড়ায় ছেলেমেয়েদের আগ্রহ কমেছে। তাঁদের আগ্রহ ফেরাতে সবার আগে পাঠ্যসূচিকে ঢেলে সাজাতে হবে।

তাৎক্ষণিক বুদ্ধি দিয়ে মুখে মুখেই চমৎকার ইংরেজি-বাংলা পদ্য রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন দাদাঠাকুর। তাঁর জঙ্গিপুরের ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হত জঙ্গিপুর সংবাদ, ‘বোতল পুরাণ’ ইত্যাদি নানা রচনা। বোতল পুরাণ কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করতেন তিনি। দাম ছিল দু’আনা। উনিশ শতকের শেষে কিংবা বিশ শতকের গোড়ায় কলকাতার রাস্তায় কোনও জিনিস ফেরি করার জন্যে লাইসেন্সের দরকার হত। দাদাঠাকুরের সেই লাইসেন্স ছিল।

বোতল পুরাণ তিনি ফেরি করতেন গান গেয়ে। যেমন—‘আমার বোতল নিবি কে রে?/ এই বোতলে নেশাখোরের/ নেশা যাবে ছেড়ে/ বোতল নিবি কে রে?’’ ভোটের প্রতিশ্রুতি নিয়ে দাদাঠাকুরের ব্যঙ্গ সে সময়ে অনেকের মুখে মুখে ফিরত। যেমন—‘ভোট দিয়ে যা, আয় ভোটার আয়/ মাছ কুটলে মুড়ো দিব, গাই বিয়ালে দুধ দিব...’ পণপ্রথা থেকে নেশা—বহু বিষয়ে সমাজের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হেনেছেন তিনি।

এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশের শংসাপত্র। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।

জঙ্গিপুরের বিদায়ী পুরপ্রধান সিপিএমের মোজাহারুল ইসলাম মানছেন, দাদাঠাকুরের জন্যেই জঙ্গিপুরের পরিচিতি। তাঁর অভিমান, ‘‘কিন্তু সরকার বা প্রতিষ্ঠান—কেউই তাঁর যোগ্য মর্যাদা দেয়নি। পুরসভা তাঁর নামে মুক্ত মঞ্চ গড়েছে, শহরের প্রবেশ পথে মূর্তি বসিয়েছে। তা দিয়ে কি তাঁর অমর কীর্তিকে ছোঁয়া যায়?’’ তবে তাঁর আশ্বাস, পরবর্তী পুরবোর্ড এ নিয়ে ভাববে। শুধু জন্ম-মৃত্যুর দিনে স্মরণ নয়, তাঁর সাহিত্য কীর্তি, প্রতিদিনের ব্যবহারের জিনিস, তাঁর ব্যবহৃত প্রাচীন মুদ্রণ যন্ত্র নিয়ে সংগ্রহশালা করার কথাও জানিয়েছেন তিনি। তৃণমূলের জেলা শিক্ষা সেলের চেয়ারম্যান শেখ ফুরকানও এ বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি বিষয়টি রাজ্য সরকারের কাছে তুলে ধরার আশ্বাস দিয়েছেন।

দাদুর প্রতি উপেক্ষায় রীতিমতো অভিমানী দাদাঠাকুরের নাতি সমীর পণ্ডিত। তেলেভাজার দোকানী কার্তিক সাহাকে জঙ্গিপুর পুরসভার কমিশনার করতে ভূমিকা ছিল দাদাঠাকুরের।

সেই জঙ্গিপুর পুরসভা থেকেই কংগ্রেসের বিদায়ী কাউন্সিলর তথা বিরোধী দলনেতা সমীর এ বারও জিতেছেন। তাঁর কথায়, দাদুর জীবনে দুঃখ, কষ্টের মাঝেও যে শ্লেষাত্মক রসবোধ দেখা যায়, তা ক’জনের মধ্যে মেলে। এই সময়ে দাদুর মতো মানুষের বড় প্রয়োজন। যিনি সহজেই কশাঘাত করতে পারবেন মানুষের মূল্যবোধহীনতাকে।

সাবলীল ছড়ায় ধরিয়ে দেবেন আমাদের ভুল। দাদাঠাকুর কলকাতায় গিয়ে যেমন কলকাতার ভুল ধরেছেন, তেমনি সমাজনেতার মূল্য কষে দিয়েছেন। এমন মানুষকে জানার আগ্রহ কই!

ক্ষোভের সঙ্গেই তিনি বলেন, ‘‘শহরের প্রবেশ পথের মূর্তিতে ময়লা জমেছে। পাখির বিষ্ঠায় একাকার। কাকে আর কী বলব?’’

Biman Hazra Jangipur Dada Thakur samiul shek
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy