Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মারণ যুদ্ধে স্কুলের বাজি সোনার মুঠি

যে গাঁয়ে অনেক বাড়িতেই হাঁড়ি চড়াতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়, সেখানে বড় অসুখ-বিসুখে টাকা কে জোগাবে? কারই বা আছে বিমা? সেখানে তো ‘আপনা হাত জগন্নাথ!’ মুঠিতে যদি ধরা থাকে সোনার ধান তো সেই সোনার মুঠির দানেই উপচে যেতে পারে গোলা।

সঞ্চয়: ভরে উঠল পড়ুয়াদের ধানে। নিজস্ব চিত্র

সঞ্চয়: ভরে উঠল পড়ুয়াদের ধানে। নিজস্ব চিত্র

অনল আবেদিন
খড়গ্রাম শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৭ ১৫:৩০
Share: Save:

বছর দুয়েক আগে চেষ্টা করেও নবম শ্রেণির শর্মিলা খাতুনকে ক্যানসারের হাত থেকে ছিনিয়ে আনতে পারেননি খড়গ্রামের ইন্দ্রাণী হাসনা মায়ানি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকেরা। কিন্তু মৃত্যুর মুখের সামনে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ধরার চিন্তাটা সেই থেকেই শুরু হয়েছিল।

ভাবনাটা আরও দৃঢ় হয় পরের বছর, যখন জানা যায় সপ্তম শ্রেণির নবাব শেখের হার্টে বাইপাস সার্জারি করাতে হবে। তার বাবা বসির শেখ খেতমজুরের কাজ করেন, তাঁর সেই সামর্থ্য কোথায়? স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক মির আশরাফ আলি বলেন, ‘‘শেষমেশ দুর্গাপুর মিশন হাসপাতাল বিনা খরচে বাইপাস করে দেওয়ায় ওর প্রাণ বেঁচেছে। দুই ছাত্রছাত্রীর দু’টি ঘটনাই আমাদের চোখ খুলে দিল।’’

যে গাঁয়ে অনেক বাড়িতেই হাঁড়ি চড়াতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়, সেখানে বড় অসুখ-বিসুখে টাকা কে জোগাবে? কারই বা আছে বিমা? সেখানে তো ‘আপনা হাত জগন্নাথ!’ মুঠিতে যদি ধরা থাকে সোনার ধান তো সেই সোনার মুঠির দানেই উপচে যেতে পারে গোলা।

শিক্ষক সৈয়দ তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘সব ক্লাসে বলা হল, বোরো ধানের সময়ে এক বার আর আমনের সময়ে আর এক বার মিলে বছরে মাত্র দু’বার দু’মুঠো ধান স্কুলে জমা দিলেই ধানের পাহাড় হয়ে যাবে। সেই ধান বিক্রি করেই অসুস্থ দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীর চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে। এই প্রকল্পের নাম আমরা দিয়েছি ‘স্বর্ণমুষ্টি’। শুরু থেকেই বিপুল সাড়া পড়েছে।’’

আরও পড়ুন
‘খোলসা করে বলি, আমি মনের মানুষ পেয়ে গিয়েছি’

স্কুল বলেছে এক মুঠো সধান দিতে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা কেউ আধ কেজি, কেউ এক কজি করে ধান নিয়ে এসে উৎসবের মেজাজে জমা করেছে স্কুলের ‘স্বর্ণমুষ্টি’ গোলায়। মাত্র চার দিনে মজুতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ কুইন্ট্যাল। পাশের গ্রাম আলিনগরের লরি চালক নুর ইসলামের মেয়ে রিঙ্কি খাতুন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। ধান জমা দেওয়ার লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে সে বলে, ‘‘আমাদের এক বিঘা জমিতে ধানচাষ হয়। স্কুলের কারও বড় অসুখ হলে এই ধান বেচা টাকাকেই তার চিকিৎসা করা হবে।’’

আলিনগরের খেতমজুর নবকুমার লেটের ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র গৌতম, রামচন্দ্রপুরের কৃষক সাবির শেখের মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী বিষ্টি খাতুন, ইন্দ্রাণীর কৃষিজীবী সুব্রত সাহার মেয়ে সুমিতা— সকলের হাতে একটা করে ধান বোঝাই ঝোলা। চার দিনেই হাজার দেড়েক ছাত্রছাত্রীর ধান জমা পড়েছে। এর পরে গরমের ছুটি পড়ে গিয়েছে। তার পরে আরও শ’তিনেক ছেলেমেয়ে ধান জমা দেবে।

দ্বারকা নদীপাড়ের ইন্দ্রাণী, রুহিগ্রাম, আলিনগর, পুড়াডাঙা, রামচন্দ্রপুরের মতো কয়েকটি গরিব তফসিলি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কৃষিজীবী পরিবারের ছেলেমেয়েদের এই উদ্যোগে আপ্লুত মুর্শিদাবাদ জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) পূরবী বিশ্বাস দে। উদ্যোগের শরিক হতে চায় জেলা ‘শিক্ষাভবন’ও।

পূরবী বলেন, ‘‘শৈশব থেকেই সহমর্মিতা ও সঞ্চয় মনস্কতার জন্ম হয়। স্কুলে সেই বৃত্তিচর্চার উদ্যোগ খুবই ভাল প্রয়াস। তাই শিক্ষাভবন থেকে আমরাও ধান কিনে ওই স্কুলে পাঠিয়ে এই মহৎ উদ্যোগের শরিক হব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE