Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

শেষ শীতে ‘নবান্ন’ লালবাগের স্কুলে

কেউ নিঃশব্দে চেটে চলেছে হাতের চেটো। কেউ বা চাকুম-চুকুম। কেউ নিজেরটা খেয়ে হাত বাড়িয়েছে বন্ধুর দিকে। কেউ আবার নিজেরটা বিলিয়ে দিতে পেরে তৃপ্ত। শনিবার শেষ-শীতে হেমন্তের ‘নবান্ন’ এ ভাবেই পালন করল লালগোলার এমএন অ্যাকাডেমির পড়ুয়া-শিক্ষকেরা।

তখন পাতে পড়ছে পিঠে-পায়েস।

তখন পাতে পড়ছে পিঠে-পায়েস।

অনল আবেদিন
লালগোলা শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০১:৩৪
Share: Save:

কেউ নিঃশব্দে চেটে চলেছে হাতের চেটো। কেউ বা চাকুম-চুকুম। কেউ নিজেরটা খেয়ে হাত বাড়িয়েছে বন্ধুর দিকে। কেউ আবার নিজেরটা বিলিয়ে দিতে পেরে তৃপ্ত। শনিবার শেষ-শীতে হেমন্তের ‘নবান্ন’ এ ভাবেই পালন করল লালগোলার এমএন অ্যাকাডেমির পড়ুয়া-শিক্ষকেরা।

এ দিন মিডডে মিলে পড়ুায়াদের খিচুড়ি ও পাঁপড় ভাজার খেতে দেওয়ার সঙ্গে হাতে তুলে দেওয়া হয় নলেন গুড়ের পায়েস ও পিঠে বোঝাই কৌটো। পরমানন্দে সেই পিঠে-পায়েস চেখে দেখল পঞ্চম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণির কমবেশি ৮০০ পড়ুয়া। তবে তার আগে স্কুলের শুরুতে ‘নবান্ন’ বিষয়ে ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা দেন প্রধান শিক্ষক সুব্রত চক্রবর্তী।

স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, এলাকার শিক্ষার প্রসারে বাবার নামে লালগোলায় এমএন অ্যাকাডেমি নামের ওই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন লালগোলার দানবীর মহারাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায়। অতীত গরিমায় উজ্জ্বল সেই বিদ্যালয়ের করুণ দশার শুরু কয়েক বছর আগে। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা নির্বিশেষ পড়ুয়াদের মিডডে মিল খেতে দেওয়া হয় খোলা আকাশের নীচে। মুখে দেওয়া যেত না মিল ডে মিলের খাবারও। পড়ুয়াদের খেতে হত বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক-যুক্ত দূষিত জলও।

এ সবের প্রতিবাদে দলমত নির্বিশেষ সোচ্চার হন শিক্ষক, পরিচালন সমিতির সদস্য ও অভিভাবকেরা। লালগোলা পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান অজয় ঘোষের ছেলেও ওই বিদ্যালয়ের ছাত্র। অজয়বাবু বলেন, ‘‘সম্মিলিত আন্দোলনের ফলে বিডিও তদন্ত করেন। তদন্তে দুর্নীতি ধরা পড়ে।’’

তাই লালবাগ মহকুমাশাসকের নির্দেশে গত বছরের জুন মাসে মিড-ডে-মিলের জন্য নতুন কমিটি গড়া হয়। নয়া কমিটিতে তিন শিক্ষক— রবীন মণ্ডল, বিরিঞ্চি হালদার ও জাহাঙ্গির মিঞা এ ব্যাপারে নতুন পথে হাঁটতে শুরু করেন। ফলে পড়ুয়াদের পাতে পাতলা জলের মতো খিচুড়ির বদলে সরকারি বরাদ্দের মাংস, ডিম পড়ে। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন দেওয়া হয় চিকেন-ফ্রাইড রাইস, গ্রীষ্মের দাবদাহে চিনিপাতা দই, কোনও দিন রসগোল্লা। অবশেষে এ দিন পিঠে-পায়েস।

খোলা আকাশের নীচে খাওয়ার দিনও উধাও। এখন ঘরের ভিতরে টেবিল-বেঞ্চে ব্যবস্থা করা হয়েছে। হয়েছে বিশুদ্ধ পানীয় জলেরও ব্যবস্থা।

সরকারি ধরাবাঁধা খরচের তহবিল থেকে এ অসাধ্য সাধন কী ভাবে?

শিক্ষক রবীন মণ্ডল বলেন, ‘‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। তার জন্য প্রয়োজন ছাত্রদের প্রতি দরদ, নিষ্ঠা ও সততা।’’ বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিলেন মিডডে মিল কমিটির আরও এক সদস্য-শিক্ষক জাহাঙ্গির মিঞা। তিনি জানান, সরকার থেকে সব্জি, ডিম, তেল-মশলা ও জ্বালানির দাম দেওয়া হয় খুচরো বাজার দর অনুসারে। কিন্তু তাঁরা সরাসরি চাষির কাছ থেকে সব্জি কেনায় কিছুটা সস্তা হয়। পাইকারি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অনেক কম দামে তেল-মশলা কেনা হয়। ফলে মাসের শেষে বেশ কিছু টাকা বেঁচে যায়। সেই টাকা দিয়েই শিশুদের মুখের স্বাদ পাল্টানোর ব্যবস্থা ও খাদ্য-সংস্কৃতির পাঠ-পরিচয় দেওয়া হয়। শিক্ষকদের পাশাপাশি ছাত্ররাও নিজেদের পুরনো অভ্যাস বদলে সক্রিয় করেছে তুলেছে তাদের শিশু সংসদ। শিক্ষক বিরিঞ্চি হালদার বলেন, ‘‘শিশু সংসদের পক্ষ থেকে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে রয়েছে একজন প্রধানমন্ত্রী ও একজন খাদ্যমন্ত্রী। তাদের সক্রিয় উদ্যোগের ফলে দৈনিক ৭-৮ শো পড়ুয়ার মিডডে মিলের বিশাল কর্মযজ্ঞ সুষ্ঠু ভাবে চালানো সম্ভব হচ্ছে।’’

এ দিকে, পড়ুয়াদের মুখে পরমান্ন তুলে দিতে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর ১৮ জন রাঁধুনি পিঠে, পুলি, পায়েস রাঁধেন। নবান্ন উদ্‌যাপনে পদ্মাপাড়ের ওই বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণির দুই ‘প্রধানমন্ত্রী’—যথাক্রমে নুর মহম্মদ ও প্রমিত দাস বেজায় খুশি। ওই দুই ‘প্রধানমন্ত্রী’ বলে, ‘‘আগামী বর্ষায় আমাদের ইলিশ মাছের ঝোল ও ভাত খাওয়াবেন বলেছেন। শুনে এখনই জিভে জল আসছে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE