Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

হে স্বাধীনতা, আমাদের পাট্টা দাও

চরের পলিতে হলদেটে বাঁশের আগায় পতপত করে ওড়ে তেরঙ্গা, তাকে ঘিরে চরের বাসিন্দারা মাথা নিচু করে প্রার্থনা করেন— হে স্বাধীনতা, আমাদের পাট্টা দাও। লিখছেন গৌরব বিশ্বাসচরের পলিতে হলদেটে বাঁশের আগায় পতপত করে ওড়ে তেরঙ্গা, তাকে ঘিরে চরের বাসিন্দারা মাথা নিচু করে প্রার্থনা করেন— হে স্বাধীনতা, আমাদের পাট্টা দাও। লিখছেন গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৭ ০৩:১৭
Share: Save:

এ পার স্বাধীন, ও পার স্বাধীন, মধ্যিখানে চর!

সেই চরাচরেও স্বাধীনতা দিবস আসে। খুদেরা ইস্কুলে যায়। শিক্ষকেরা স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে দু’চার কথা বলেন। সমস্বরে আওয়াজ ওঠে—বন্দে মাতরম্। তার পরে লজেন্স চুষতে চুষতে বাড়ি ফেরা।

—‘হ্যাঁ রে, এত সক্কাল সক্কাল বাড়ি চইলি এইলি যে!’

—‘আজ তো ১৫ অগস্ট গো! স্বাধীনতা দিবস!’

গোলার গায়ে গোবর লেপতে লেপতে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন মাঝবয়সী মহিলা, ‘অ! তাইলি তো মাস্টারদের ভারী মজা। তোদেরও। তা এক কাজ কর দিকি। একছুটে আব্বাকে চাট্টি খাবার দিয়ে আয়।’

—‘আম্মা, আমাদের বাড়িতে পতাকা নাই ক্যান?’

—‘তুর আব্বাকে জিগাস। আমি কী কইরি বুইলব?’

ইস্কুল থেকে পাওয়া কাগজের একটা তেরঙ্গা হাতে খুদে ছোটে খেতের দিকে।

চারপাশে বুনো ঘাস, বাতাসে বর্ষার সোঁদা গন্ধ। বুকের ভিতরে হাপরের ওঠানামা। মাথার ভিতরে স্কুলের শিক্ষকদের ভাষণ— ‘পরাধীনতার যন্ত্রণা, সুভাষ বোস, ক্ষুদিরাম, গাঁধীজি...।’

• রাত পোহালেই ১৫ অগস্ট। পাড়ার মোড়ে, ক্লাবে, মাচায় সাউন্ড বক্সে গাঁক গাঁক করে বাজছে— ‘জয় হো’, ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কি লোগো’ কিংবা ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’...। ছেলেপুলেদের উৎসাহের অন্ত নেই।

—‘সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে চলে আসবি কিন্তু।’

—তার আগেই সব প্রোগ্রাম শেষ হয়ে যাবে তো?

—আলবাত! মেজদাকে এ বার একটু কম বকবক করতে বলবি।

—‘আর তোদের কী খবর রে, সব এনেছিস তো?’

—‘সকলেই কি তোর মতো? সব আগের রাতে তোলা আছে!’

—‘মাংস, সোডা, বরফ?’

—‘হ্যাঁ রে বাবা, সব থাকবে। তুই শুধু সকাল সকাল চলে আসিস। আগের বারের মতো ডোবাস না!’

—আর এটা কী করেছিস? ডিপিটা বদলাবি না? আমার ডিপিতে তো তেরঙ্গা।

—ভাল বলেছিস ভাই, দাঁড়া আমারটাতেও করে নিই।

আবার একটা ১৫ অগস্ট। আবার একটা পড়ে পাওয়া ছুটি। এমনিতেই এ বার স্বাধীনতা দিবস মঙ্গলবার। শনি, রবি ছুটি। সোমবারটা ‘ম্যানেজ’ করতে পারলেই কাছেপিঠে পুরী, দিঘা কিংবা মন্দারমণি। দার্জিলিং বাদ। কেননা সেখানে হাওয়া গরম। যদি কোথাও না যাওয়া হয় তা হলে কোনও আত্মীয়ের বাড়ি। না হলে সপরিবার গুছিয়ে এ দিক ও দিক ঘুরে, পপকর্ন খেতে খেতে জমিয়ে সিনেমা দেখে, ডিনারটা কোনও রেস্তোরাঁয় সেরে বাড়ি ফেরা।

• ঘোলা পদ্মার উপরে সামিয়ানার মতো ঝুলছে কুচকুচে কালো মেঘ। মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি নামছে। ক্লান্তি ভুলে ভিজতে ভিজতে অবিরাম পারাপার করছে হিসেবি নৌকো। পেটের মধ্যে চাল, ডাল, আনাজ, জ্বালানি। উপরে তার্পোলিন দেওয়া। জিনিসপত্তর যাতে ভিজে না যায়। হাট শেষে এ পার থেকে নৌকা ও পারে পৌঁছলে তবেই উনুন জ্বলবে। হাঁড়ি চড়বে। ভাতের গন্ধে ম ম করবে চরাচর।

কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে কোলের ছেলে। বড়টা ঘ্যানঘ্যান করছে, ‘‘ও আম্মি, ভাত কোখুন হবে?’’ বাড়ির কর্তা গামছা নিয়ে স্নানের তোড়জোড় করছেন, ‘‘আর কদ্দুর গো?’’ গরম ভাত বাড়তে বাড়তে কর্ত্রী হাসছেন, ‘‘হোয়ি গিয়েচে। শিগ্‌গির আসো।’’

নিকোনো উঠোন আছে, পেটে খিদে আছে, বুকে ভালবাসা আছে, অন্তরাত্মায় ভয় আছে, সাহস করে পালিয়ে বিয়ে করা আছে, দায়িত্ব নিয়ে বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করা আছে, মেনে চলা শাসন আছে, আবশ্যিক অনুশাসন আছে, ভারী বুটের আওয়াজ আছে, ভাষা বুঝতে না পারার শাস্তি, বেমক্কা চড়-থাপ্পড় আছে। কিন্তু স্বাধীন দেশে থেকেও স্বাধীনতা নেই!

আরও পড়ুন:বিক্ষিপ্ত অশান্তি, ‘উধাও’ কমিশন

নিজের গ্রাম থেকে যখন তখন বেরোনো যাবে না। ইচ্ছেমতো পদ্মা পার হওয়া যাবে না। ভোটার কার্ড ভুলে যাওয়া যাবে না। এবং আরও অনেক না। পদ্মা পেরিয়ে চরের গ্রামে যেতে প্যান কার্ড নয়, আধার কার্ড নয়, ড্রাইভিং লাইসেন্সও নয়— দরকার ভোটার কার্ড।

যে কার্ড দেখে মুর্শিদাবাদের উদয়নগর খণ্ড, চরপরাশপুর, কাকমারির বরকত আলি, হাসান শেখেরা মাচায় বসে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েন, ‘‘ও কত্তা, এ কার্ড আপনি কুতায় থোন? আলমারির ভেতরে নাকি? এ তো এক্কেবারে লতুন গো!’’

ভোটার কার্ড চকচকে হলে যে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়, কে জানত!

বরকত বলে চলেন, ‘‘সে তো বাবু, আপনাদের কার্ড লতুন হবেই। আপনাদের তো আর কতায় কতায় কার্ড দেখাতে হয় না! কার্ড তো বের করেন খুব দরকারি কাজে। আর সেই ভোটের সময়। আর আমরা?’’

পাশ থেকে খেই ধরেন বরকতের থেকে বয়সে একটু বড় হাসমত শেখ, ‘‘আমাদের তো বাবু কার্ডই সব। রাইতির বেলায় এ কার্ড আমরা বালিশের তলায় রেইকিই ঘুমাই। সক্কালে উইটিই তো ওইডাই সব্বার আগে দরকার।’’

ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট করে দিলেন তিনিই, ‘‘বুইলেন না তো? মানে ধরুন, এই যে কার্ড (লুঙ্গির কষি থেকে বের করে) দ্যাখতাসেন, এই কার্ড আছে মানে ছবিডা আছে, ছবিডা আছে মানে আমি আছি। আর আমি আছি মানে আমার পোলা-বউ-পরিবার সক্কলে আছি। কার্ড নাই মানে আমিও নাই। আমি নাই, মানে কিস্যু নাই।’’ বরকত বলে চলেছেন, ‘‘আর সেই কাণেই তো আমাদের কার্ডটা বড় তেলচিটে। নোংরা। তা বাবু আমাদের স্বাধীনতার কতা আপনাদের শহরের গিয়ি বুইলবেন তো?’’

আটপৌরে সেই মাচা থেকে ইস্কুল দেখা যায় না। কিন্তু লম্বা বাঁশের ডগায় বাঁধা তেরঙ্গা উড়ছে। সাদা অংশের মধ্যিখানে চাকাটাও যেন বনবন করে ঘুরছে। কিন্তু সত্যি সত্যিই কি ঘুরছে?

মাচার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়াল বিএসএফের জিপসি।

—‘কী ব্যাপার?’

—‘আজ্ঞে, খবরের কাগজ থেকে এসেছি।’

—‘বেশ। কিন্তু কোনও ছবি তুলবেন না। কাজ হয়ে গেলে এক বার ক্যাম্পে আসুন।’

বরকত ফিসফিস করেন, ‘‘কী বাবু, কী বুইলেন? ওরাই এখানকার হত্তা-কত্তা-বিধাতা। ওদের মর্জিতেই সীমান্তে সুয্যি ওঠে, অস্ত যায়। পাখি ওড়ে। আমরাই খালি না ঘরকা, না ঘাটকা হয়ে থেকে গেলাম। আচ্ছা বাবু, আমরা কেন স্বাধীন হলাম না?’’

স্বাধীনতার এত বছর পরেও এই প্রশ্নটা শুনতে হয়। শুনতে হচ্ছে। চরের পলিতে হলদেটে বাঁশের আগায় পতপত করে ওড়ে তেরঙ্গা, তাকে ঘিরে চরের বাসিন্দারা মাথা নিচু করে প্রার্থনা করেন— ‘হে স্বাধীনতা, আমাদের পাট্টা দাও’।

• বছর কয়েক আগের কথা। কলকাতার নন্দন চত্বর।

কাঁপাকাঁপা গলায় এক মহিলা ককিয়ে উঠলেন—“আমার ছেলের খুনের বিচার চাই। আপনারা বিচার দেবেন না?”

পুত্রহারা মায়ের এমন আর্তি শুনে যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল ব্যস্ত কলকাতা। মুক্তমঞ্চকে ঘিরে থাকা ভিড়ের মধ্যে তখন পিন পড়ার নিস্তব্ধতা। পড়ন্ত বিকেলে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে পুত্রহারা ওই মহিলা বলে চলেছেন, “আমতেল মাখা মুড়ি নিয়ে বাপ-ব্যাটা দু’জনেই কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে মাঠে গিয়েছিল তিল ঝাড়াই করতে। স্বামী বাড়ি ফিরল। ছেলে ফিরল না। ১৯ বছরের তরতাজা ছেলেটাকে হাত-পা ভেঙে, গুলি করে, ভোজালি দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলল বিএসএফ। ঝড়-জলের রাতে তন্নতন্ন করে কোথাও খুঁজে পাইনি। যখন পাওয়া গেল তখন ছেলের মুখটা পর্যন্ত দেখতে দিল না গো। চুরি, ছিনতাই, খুন, পাচার— ও তো কিছুই করেনি। তাহলে কেন আমার ছেলেকে ওরা শেষ করে দিল? এই খুনের বিচার চাই। আপনারা বিচার দেবেন না?”

দিনভর এমন নানা অভিজ্ঞতার কথা নিজের মুখে শুনিয়েছিলেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লোকজন। বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে কলকাতার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের সামনের ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ।

সংস্থার সম্পাদক কিরীটী রায় বলছিলেন, “ছিটমহলে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। সেই যন্ত্রণার কথা সবাইকে জানাতে এমন আয়োজন।’’

সেই মঞ্চেই মুর্শিদাবাদের সীমান্তঘেঁষা গ্রামেরই এক পুত্রহারা মহিলা কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিলেন। ২০১০ সালে তাঁর ছেলেকে বিএসএফ মেরে ফেলে বলে তাঁর অভিযোগ। সেই খুনের বিচার চেয়ে বছর তিনি লড়াই করে চলেছেন। এই অনুষ্ঠানের কথা শুনে আর দেরি করেননি সীমান্তের ওই মহিলা। দিনের দিন পৌঁছতে পারবেন না বলে আগের রাতেই বহরমপুর থেকে শিয়ালদহের ট্রেন ধরেছিলেন। রাতভোরেই পৌঁছে গিয়েছেন কলকাতায়। পরনে নতুন সুতির ছাপা শাড়ি। স্টিকারটা পর্যন্ত তুলতে ভুলে গিয়েছিলেন। কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। ফের নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছেন, “এ লড়াইয়ে আমাকে জিততেই হবে। না হলে মরেও যে শান্তি পাব না।”

মুর্শিদাবাদের ওই মহিলা একা নন, উত্তর ২৪ পরগনা থেকে এসেছিলেন এক প্রৌঢ়া।

নুন আনতে ভাত ফুরনো সংসারে পোষা ছাগলের জন্য ‘বর্ডারে’ গিয়েছিলেন পাতা আনতে। অভিযোগ, পাতা জোটেনি, জুটেছিল বিএসএফের বেধড়ক মার। হাসপাতালে ভর্তিও ছিলেন বেশ কয়েক দিন। সে দিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে ওই প্রৌঢ়া বলছিলেন, “বিএসএফ তো আমাদের মানুষ বলেই মনে করে না। বর্ডারের মানুষের কি বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও নেই?” অধিকার? এ বড় জটিল প্রশ্ন? রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করতে হয় সমঝে! না হলে বিপদ বাড়ে বই কমে না! কেমন বিপদ? প্রান্তবাসীরা জানাচ্ছেন, তাঁদের অবস্থা শাঁখের করাতের মতো। যেতেও কাটে। আসতেও। এক দিকে বিএসএফের সন্দেহ। অন্য দিকে ও পার থেকে আসা লোকজনের চোখরাঙানি। কাঁটাতারের ওপারে রয়েছে বিঘের পর বিঘে ভারতীয় জমি। রয়েছে ভারতীয় গ্রাম। বিএসেফের অনুমতি নিয়ে সেখানে চাষ করতেও
যেতে হয়।

পাশাপাশি শুয়ে রয়েছে দু’টো স্বাধীন দেশের জমি। সেখানে চাষ করছেন দু’দেশের গরিব চাষি। জমির একই আলে রাখা থাকছে দু’দেশ থেকে আনা জলখাবার। সে খাবার ভাগ করে খান দু’জনেই। খেতে খেতে সুখ-দুঃখের কত গল্প। কিন্তু কাজ করার সময় এক জন আড় চোখে দেখে নেন আর এক জনকে। এক জনের মনে হয়, ‘‘ওর হাতের কাস্তেটা কি আজ বেশি চকচক করছে?’’

• এমন অবিশ্বাস, এমন সন্দেহ, এমন ভয় নিয়েই বেঁচে থাকতে হয় প্রান্তবাসীদের। বিএসএফ মনে করে, এ ব্যাটার সঙ্গে নির্ঘাত ও পারের কারও যোগাযোগ আছে। আটপৌরে লোকটা ভয় পান, রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পেরিয়ে গ্রামে ঢুকে তাঁর গলায় কেউ যে ওই ধারালো কাস্তেটা ধরে বসবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এমন কত ঘটনা ঘটেছে। ও দেশ থেকে এসে খুন করে চলে গিয়েছে দুষ্কৃতী। চরের মাঠে কাজ করতে গিয়েছেন তরতাজা যুবক। ভরসন্ধ্যায় ফিরে এসেছে তাঁর নিথর দেহ। চোরাপাচারের রমরমা। পাচারকারীরা তখন ফুলেফেঁপে উঠেছে। হাতে অঢেল কাঁচা টাকা। দু’হাতে সে টাকা খরচ হচ্ছে সীমান্তের গ্রামে। যা দেখে চোখ টাটিয়ে গিয়েছে বহু লোকের। বিশ্বাস করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ও পার বাংলার কোনও যুবকের সঙ্গে। এ দেশে একটা নিশ্চিন্ত ডেরার জন্য হাসতে হাসতে বিয়ে করেছে ভিনদেশি সেই যুবকও। থেকে গিয়েছেন শ্বশুরবাড়িতে।
তার পর?

এক দিন বিএসএফের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে সেই যুবকের শরীর। পাথরের মতো স্থির চোখে সেই দেহের দিকে তাকিয়ে বসে থেকেছেন অভাবি পরিবারের সেই মেয়ে। বিছানায় নাগাড়ে কেঁদে চলেছে তাঁর দুই নাবালক। মুরুটিয়া সীমান্তের সেই মহিলা বলছেন, ‘‘বাবা-মায়ের কথা ফেলতে পারিনি। বিয়েটা করেছিলাম। বহু বার ওকে বলেছিলাম, পাপের কারবার ছেড়ে দিতে। কথা শোনেনি। মাঝখান থেকে সব ছারখার হয়ে গেল।’’

তাই বলে কিন্তু হাল ছেড়ে দেননি সীমান্তের ওই মহিলা। কষ্ট করে বড় করেছেন ছেলে দু’টোকে। অনেক দিন পর্যন্ত যে ছেলে দু’টো জানতে চেয়েছে, তাঁদের আব্বা কোথায়? কী ভাবে মারা গিয়েছে? তাদের দাদা-দাদি কোথায়? ইদে তাঁরা কেউ আসে না কেন? তাদের আব্বা কি সেমুই খেতে ভালবাসত? এখন তারা সত্যিটা জানে। সেটা মেনেও নিয়েছে। দিনভর তারা পরিশ্রম করে। তাদের একটাই লক্ষ্য— আম্মা যেন ভাল থাকে। আম্মা যেন খুশি হয়। আম্মাকে যেন আর কাঁদতে না হয়! সীমান্তে এমন বহু ছেলেমেয়ে আছে যাঁরা পিতৃপরিচয় ছাড়াই বড় হয়েছে। বড় হচ্ছে। কারণ, তাঁদের বাবার কড়া নির্দেশই ছিল—অকারণে কোথাও বাপের নাম বলার দরকার নেই। সে নাম লেখা আছে শুধু পুলিশ, বিএসএফ, হাসপাতাল কিংবা মর্গে।

আর যাঁরা এ পার থেকে বিয়ে করে ও পারে চলে গিয়েছে? ‘মাঝে মাঝেই আসব’ বলেও আসা হয়নি দু’দশ বছর। তাঁদের খবর কেউ জানে না। শুধু ঘোলাটে চোখে বৃদ্ধা চেয়ে থাকেন বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা কাঁটাতারের দিকে। ওই দূরে, খেতের পিছন থেকে শাড়িপরা একটা মেয়ে কি হেঁটে আসছে? মুখটা আবছা। হাঁটাচলা অবিকল তাঁর মেয়ের মতো। রোজ এই একই ভুল তিনি করেন। করেই চলেন। বাড়ির লোকজন বর্ডারের রাস্তায় এসে বকাঝকা করেন, ‘‘এই বয়সে একা একা রাস্তায় কেন চলে আসো? কত বার তোমাকে নিষেধ করেছি?’’ শেষ শ্রাবণে বৃষ্টি নামে। ধুয়ে যায় বৃদ্ধার চোখের জল। শুধু গলার কাছে নোনতা ভাবটা কাটতেই চায় না।

• গ্রামের শেষ প্রান্ত দিয়ে বয়ে চলেছে তিরতিরে মাথাভাঙা। ও পারে মহিষকুণ্ডি, জামালপুর। জিলা কুষ্টিয়া। বাংলাদেশ। ও পারের ঘাটে স্নান করতে এসে প্রশ্নটা ছুড়ে দেন কেউ, ‘‘কী কর্তা, স্বাধীনতা দিবসে আপনারা কী কইরত্যাসেন?’’ এ পার থেকে ম্লান গলায় উত্তর যায়, ‘‘ওই যেমন হয় ফি বছর। ইস্কুলে পতাকা তুলবে মাস্টাররা। ছেলেপুলেরা থাকবে। আমাদের আর স্বাধীন হওয়া হল কই!’’

ভৌগোলিক ভাবে চরমেঘনা আর পাঁচটা গ্রামের মতো নয়। হোগলবেড়িয়ার মেঘনা বিএসএফ ক্যাম্প থেকে প্রায় একশো মিটার দূরে ইন্দো-বাংলাদেশ বর্ডার রোড। কাঁটাতারের বেড়া। রাস্তার এ পাশে বিএসএফের নজরদারি চৌকি। সেখানে ভোটার কার্ড দেখিয়ে, প্রশ্নবাণ সামলে বিএসএফের অনুমতি মিললে তবেই ছাড়পত্র মেলে সে গ্রামে যাওয়ার। কাঁটাতারের গায়ের লোহার গেট পেরিয়ে থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে এগিয়ে গেলে চরমেঘনা। তার পরে মাথাভাঙা। গ্রাম থেকে বেরনোর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। সবথেকে বড় কথা, সন্ধ্যার পরে বন্ধ হয়ে যায় কাঁটাতারের গায়ের ওই লোহার গেট। দেশে থেকেও যেন দেশের বাইরে। দুই স্বাধীন দেশের মাঝে অসহায় ভাবে জেগে থাকে চরমেঘনা। গ্রামের বাসিন্দা অনিমেষ মাহাতো বলছেন, ‘‘কী ভাগ্য করে যে এই গ্রামে জন্মেছিলাম! উত্তরবঙ্গে ছিটমহলগুলোরও একটা হিল্লে হল। অথচ আমাদের কিছুই হল না। আমাদের দাবি তো বেশি কিছু নয়। শুধু বলছি, কাঁটাতারটা গ্রামের বাইরে দিয়ে দিতে। সরকার যদি সে কথাটাও কানে না তোলে, কী করব বলুন তো?’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘সব থেকে বড় কথা কী জানেন তো? স্বাধীন দেশে বাস করেও এই পরাধীনতার যন্ত্রণাটা আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। যাঁদের সামর্থ্য আছে তাঁরা এখানকার পাট চুকিয়ে দিয়ে কাঁটাতারের ও পারের গ্রামে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু সে ক্ষমতাও তো আর সকলের নেই।’’

তবুও এ গ্রামেও স্বাধীনতা দিবস আসে। বছর কয়েক আগে আসা বিদ্যুতের সৌজন্যে টিভিতে চলে নানা অনুষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। হাঁ করে সে সব শোনে চরমেঘনা। তারপর ফের ভোটার কার্ডটা পকেটে নিয়ে বাজারে বেরোয় চাষি। লজঝড়ে সাইকেল নিয়ে কাঁটাতার ডিঙিয়ে সত্যিকারের স্বাধীন দেশে টিউশন নিতে যায় স্কুলবালিকা। দূরে কোথাও তখনও মাইকে বেজে চলে—জয় হো...।

ছবি: গৌতম প্রামাণিক ও সাফিউল্লা ইসলাম

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

border Independence স্বাধীনতা
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE