কৃষ্ণনগর স্টেশনে ট্রেন থেমেছে। ব্যাগপত্তর সব বাঙ্কে রেখে শৌচাগারের দিকে ছুটেছিলেন ভগবানগোলার ইমতিয়াজ আলি। সেখান থেকে না বেরোতেই আচমকা ট্রেনের ভোঁ। ইমতিয়াজ কোনও মতে বাইরে এসে ছুটতে শুরু করেন। চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়ে প্ল্যাটফর্মে পড়ে কোনও মতে প্রাণে বেঁচেছেন। তাঁর ব্যাগপত্তর নিয়ে ততক্ষণে ট্রেন ছুটেছে শিয়ালদহের দিকে।
কী, অখিলচন্দ্র সেনের কথা মনে পড়ছে?
সেই যে নব্য শিক্ষিত বঙ্গ যুবক যিনি প্রচুর কাঁঠালের কোয়া খেয়ে ট্রেনে উঠেছিলেন। প্রকৃতির ডাক উপেক্ষা করতে না পেরে লোটাকম্বল নিয়ে নেমে পড়েছিলেন আমোদপুর স্টেশনে। কিন্তু তাঁর ‘কাজ’ শেষ না হতেই ছেড়ে দিয়েছিল ট্রেন। এক হাতে লোটা, অন্য হাতে ধুতি সামলে দৌড়ে, প্ল্যাটফর্মে চিৎপটাং। ট্রেন অখিলচন্দ্রকে ফেলে চলে গিয়েছিল। কিন্তু অখিলচন্দ্র হাল ছাড়েননি। রেল দফতরকে লেখা তাঁর একটি অভিযোগপত্রে ১৯০৯-’১০ সাল নাগাদ সবার জন্য শৌচাগার তৈরি হল ট্রেনে।
ইমতিয়াজ এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও অভিযোগ জানাননি। তবে পূর্ব রেলের লালগোলা-শিয়ালদহ শাখায় বেশ কিছু ট্রেনে শৌচালয় না থাকায় বহু রেলযাত্রী অখিলচন্দ্রের মতো বিপাকে পড়ছেন। গত মার্চ মাস থেকে ২২৭ কিলেমিটার দূরত্বের লালগোলা-শিয়ালদহ শাখার ইএমইউ (ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট) ও এমইএমইউ (মেইন লাইন ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট’) মিলে মোট ৭টি ট্রেন চালু করা হয়েছে যেখানে শৌচাগার নেই।
ওই ট্রেনের এক ফেরিওয়ালা বলছেন, ‘‘ট্রেনে শৌচাগার না থাকার জন্য যে কী অসুবিধা হচ্ছে তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।’’ রেলের এক কর্তার যুক্তি, ‘‘শৌচালয় ব্যবহার করার জন্য ওই ট্রেনগুলি তো কৃষ্ণনগরে আধ ঘণ্টা দাঁড়ায়। তাহলে সমস্যা কোথায়!’’ যা শুনে এক নিত্যযাত্রী বলছেন, ‘‘কার কোথায় ইয়ে পাবে সেটা কি রেল কর্তৃপক্ষ ঠিক করে দেবেন? তা ছাড়া রাতে দু’টি ইএমইউ কৃষ্ণনগরে আধ ঘণ্টা থামে না।’’
ট্রেনে শৌচাগার না থাকা কিংবা থাকলেও তালাবন্ধ করে রাখার যে কী পরিণতি হতে পারে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল বছর তিনেক আগের এক ঘটনা। ট্রেনের সব ক’টা কামরাতেই ছিল শৌচাগার। কিন্তু, ব্যবহার করার উপায় ছিল না। লোহা ঝালাই করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল প্রত্যেকটির দরজা। ট্রেন থেকে নেমে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে দু’টি পা হারিয়েছিলেন ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলার বাসিন্দা বছর বাষট্টির হাবুল গঙ্গোপাধ্যায়।
খড়্গপুরে আত্মীয়ের বাড়িতে সস্ত্রীক আসছিলেন টাটানগর-খড়্গপুর লোকালে চেপে। খড়্গপুর স্টেশনে ঢোকার খানিক আগে সিগন্যাল না পাওয়ায় দাঁড়ায় ট্রেন। হাবুলবাবু নেমে রেল লাইনের পাশের ফাঁকা জমিতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ দেখেন, ট্রেন চলতে শুরু করে দিয়েছে। পড়িমড়ি করে ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করেন ওই বৃদ্ধ। দরজার রড ধরতে পারলেও পাদানিতে পা দেওয়া সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। ট্রেন ততক্ষণে গতি নিয়েছে। ট্রেন যাত্রীদের আক্ষেপ, শৌচাগার ব্যবহার করতে পারলে হাবুলবাবুকে তাঁর দু’টো পা এ ভাবে খোওয়াতে হত না।
কিন্তু তার পরেও শিক্ষা নেয়নি রেল দফতর। বহরমপুর নিত্য রেলযাত্রী সমিতির কর্ত্রী সোনালি গুপ্ত ও অন্য একটি রেলাযাত্রী সমিতির সম্পাদক এ আর খান জানান, সমস্যার কথা মাথায় রেখে পূর্ব রেলের বিভিন্ন কর্তাকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। পূর্বরেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র বলেন, ‘‘১৫০ কিলোমেটারের বেশি দূরে যাবে এমন ট্রেনে শৌচালয় করার ভাবনা-চিন্তা চলছে। শিয়ালদহ-লালগোলা লাইনের ট্রেনে ফের শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy