Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সাঁঝ-বাদলে ২

জোছনায় সওয়ার খোঁজে শুশুক

ডহর ধারে তেনারা আসেন মাঝ রাতে আর বিল পাড়ের মাঠে। সে এক নিভু নিভু আলো, রাতভর... হ্যারিকেনের আলো তেরছা করে পড়েছে, বাদল সাঁঝে এমন বৃষ্টি-ঘন গপ্পো শুনতে সেই মাঠ-পুকুর-খালপাড় ধরে হাঁটল আনন্দবাজার।দু’পার উপচে যাওয়া ভৈরবে ঘাই মেরে বেড়াচ্ছে শুশুক। খুঁজে বেড়াচ্ছে কাকে যেন! খানিক বাদেই চকজামা গ্রামের হাতিবাঁধা ঘাটের কাছে এসে দাঁড়ালেন কাইমুদ্দিন। খালি গা, হেঁটো লুঙ্গি। তাঁকে দেখেই জলে ফেনা তুলে শুশুক চলে এল ঘাটের কাছে। কাইমুদ্দিন সওয়ার হলেন তার পিঠে।

অনল আবেদিন
শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৭ ০৮:৪০
Share: Save:

ভরা ভাদর। সারা দিন ছিপছিপ করে বৃষ্টি হয়েছে। সাঁঝ ঘনাতেই মেঘ পাতলা। নীলচে আসমানে তেঁতুল ঘষা পিতল থালার মতো ফুটফুটে পুন্নিমার চাঁদ। এই এত্ত বড়!

দু’পার উপচে যাওয়া ভৈরবে ঘাই মেরে বেড়াচ্ছে শুশুক। খুঁজে বেড়াচ্ছে কাকে যেন! খানিক বাদেই চকজামা গ্রামের হাতিবাঁধা ঘাটের কাছে এসে দাঁড়ালেন কাইমুদ্দিন। খালি গা, হেঁটো লুঙ্গি। তাঁকে দেখেই জলে ফেনা তুলে শুশুক চলে এল ঘাটের কাছে। কাইমুদ্দিন সওয়ার হলেন তার পিঠে। আর ফুর্তিতে জল ছিটিয়ে শুশুক এগিয়ে চলল মাঝনদীতে। টিমটিমে কুপির চারপাশে গোল হয়ে বসে থাকা ছেলেবুড়োর মুখ হাঁ, চোখ ছানাবড়া। বাইরে ভিজে ঝোপে-ঝাড়ে টানা ঝিঁঝিঁ ডেকে চলেছে। হঠাৎ হঠাৎ টানা খানিক ডেকে চুপ করে যাচ্ছে কোলা-কুনো ব্যাঙেরা। গোলের মাঝে কথক হয়ে গল্প বলে চলেছেন নওদাপাড়ার বৃদ্ধ নকিমুদ্দিন শেখ। এ সব তো তাঁর ছেলেবেলার গল্প।

রানিনগরের পানিপিয়া-নজরানা গ্রামের খেতমজুর কাইমুদ্দিন গত হয়েছেন তা বছর পঞ্চাশ তো হবেই। প্রতি বর্ষায় ধান-পাট কাটার মরসুমে দৌলতাবাদের এলাকার বিভিন্ন গ্রামে মুনিষ খাটতে যেতেন তিনি। তখনও থানা ভাগ হয়নি, সাবেক থানা বহরমপুর। তার পূর্বপ্রান্তের গ্রামগুলো ছিল ভৈরব লাগোয়া। বিস্তৃত বাগড়ি এলাকার দোআঁশলা জমি আর নয়ানজুলিতে সার বেঁধে কাজ করতেন নানা এলাকা থেকে আমদানি হওয়া খেতমজুরের দল। কাইমুদ্দিন মাঠঘাটের কাজে তেমন পটু নন। বরং সাঁঝে গেরস্থ বাড়িতে গল্প বলাতেই তাঁর বেশি নামডাক। সে দিক থেকে নকিমুদ্দিনেরই পূর্বসূরি তিনি। বৃষ্টি মাথায় নিয়েও তাঁর খোঁজ চলত, কোন বাড়িতে তিনি গল্পের ঝুলি নিয়ে সেঁধিয়ে আছেন। আর ছিল তাঁর নদীতে খেপজাল ফেলে মাছ ধরার নেশা। ভৈরব তখন এখনকার মতো মরা নদী নয়। শ্রাবণে-ভাদরে দু’কুল ছাপানো তার টইটম্বুর যৌবন। এতটাই চওড়া যে, এ পার থেকে ও পারটা ঝাপসা দেখাত। আর পুবে হাওয়া উঠলে তার সে কী গর্জন!

নকিমুদ্দিন তখন বড় জোর দশ-বারো বছরের বালক। এ রকমই এক বাদল সাঁঝে খোদ কাইমুদ্দিনের মুখেই তাঁর শুশুক পোষার গল্প শোনা: ‘‘শিশাপাড়ার ঘাট থেকে এক দিন ভৈরবে খেপজাল ফেলেছি। কী একটা জড়িয়ে গেল। এত ভারী, টেনে ডাঙায় তুলতে পারছি না। কোনও মতে টেনে তুলে দেখি, জালের ভিতরে মাছের বদলে ছিল ইয়া বড় এক শুশুক। যদি বা ডাঙায় উঠল, পরমুহূর্তেই সে জাল সমেত আমায় নিয়ে ফের নেমে পড়ল জলে। আমিও নাছোড়বান্দা। লাফিয়ে উঠলাম তার পিঠে। তার পর এমন এক ঘুষি বাগালাম, যেন একমণি একখানা বাটখারা পড়ল তার ঘাড়ে। ব্যস! ওই এক ঘুষিতেই পোষ মেনে গেল সে শুশুক। সারা রাত তার পিঠে চড়ে গোটা নদী চষে বেড়ালাম।’’ ভরা ভাদরে ভৈরবে ঠিকরে পড়ছে পূর্ণিমার ছটা। জোছনায় ঝিকমিক করছে জলরাশি। আর শুশুকের পিঠে চেপে জলবিহার করছেন কাইমুদ্দিন। ঠিক যেন জলের নিয়ন্তা খাজা খিজির, মাছের পিঠে খাড়া দাঁড়িয়ে যিনি পার করিয়ে দেন দুর্গতের ভেলা (‌বেরা), যাঁর নামে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁয়ের আমল থেকে আজও ফি ভাদ্রের শেষ বৃহস্পতিবার হাজারদুয়ারির সামনে ভাসে আলোর ‘ব্যারা’।

‘‘হল কী, হঠাৎ আধমনি একটা বোয়াল জল থেকে লাফ দিয়ে উঠে ঝাপটা মারল কাইমুদ্দিনের মুখে। তাঁর নাক ফেটে রক্ত ঝরল। শুশুক রেগে আগুন! কাইমুদ্দিনকে ডাঙায় রেখে সে ছুটল বোয়ালের পিছনে। অনেক তাড়া করে সেই বোয়াল ধরে এনে দিল কাইমুদ্দিনের হাতে।’’

এ-ও সত্যি?

বিড়িতে সুখটান দিয়ে নকিমুদ্দিনের জবাব, ‘‘এ কী যে সে শুশুক! খাজা খিজিরের খাসবান্দা, বেহেস্তি শুশুক! অসীম তার খেমতা! সুনসান নদীতে তার পিঠে চেপে কাইমুদ্দিন কত ফেরেশতার দেখা পেয়েছে জানো? মরার পরে কার নসিবে কী লেখা আছে, তাও আগুন দিয়ে তৈরি ফেরেশতাদের থেকে শুনেছে।’’

শ্রোতারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।

আর তা দেখেই কেরোসিনের কুপি ঘেরা জটলা থেকে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে নকিমুদ্দিন বলেন, ‘‘অবিশ্বাস করবিনি বাপু! আল্লা গুনা দিবে!’’

বাইরে ফের ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি নামে। (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE