Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সাঁঝ-বাদলে ৩

গন্ধতেই মালুম হয় তেনারা চলে এসেছেন

ডহর ধারে তেনারা আসেন মাঝ রাতে আর বিল পাড়ের মাঠে। সে এক নিভু নিভু আলো, রাতভর... হ্যারিকেনের আলো তেরছা করে পড়েছে, বাদল সাঁঝে এমন বৃষ্টি-ঘন গপ্পো শুনতে সেই মাঠ-পুকুর-খালপাড় ধরে হাঁটল আনন্দবাজার।‘প্রস্তাবটা মন্দ নয়। কিন্তু রাস্তায় যদি ফের বৃষ্টি নামে?’ তৃষিতের প্রশ্ন শুনে হাসলেন অরিন্দম, ‘তোমার ভয়টা কীসের? বৃষ্টি না ভূতের?’ কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে তৃষিত উত্তর দেন, ‘ধুস, কী যে বলো! সুবীর পালের ভূতের গপ্প যেন আগে কখনও শুনিনি!’

সুদীপ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৭ ০৬:৪০
Share: Save:

দিনভর বৃষ্টি। অথচ গুমোট ভাবটা কাটছে না। অরিন্দম মুখোপাধ্যায় বাড়ির বারান্দায় তাসের বন্ধুদের অপেক্ষায় আছেন। বিকেলের পরে বৃষ্টিটা একটু ধরতেই কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই তৃষিত মৈত্র বললেন, ‘সে কী হে, বাকিদের তো কাউকে দেখছি না। তা হলে কি তাসের আড্ডা আজ বন্ধ?’ অরিন্দম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘এক কাজ করলে হয়। চলো ঘূর্ণি থেকে ঘুরে আসি। প্রতিমার কাজ কদ্দুর হল, দেখা হবে। সঙ্গে সুবীর পালের গপ্প।’

‘প্রস্তাবটা মন্দ নয়। কিন্তু রাস্তায় যদি ফের বৃষ্টি নামে?’ তৃষিতের প্রশ্ন শুনে হাসলেন অরিন্দম, ‘তোমার ভয়টা কীসের? বৃষ্টি না ভূতের?’ কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে তৃষিত উত্তর দেন, ‘ধুস, কী যে বলো! সুবীর পালের ভূতের গপ্প যেন আগে কখনও শুনিনি!’

কৃষ্ণনগর থেকে ঘূর্ণিতে মোটরবাইকে যেতে সময় লাগল সাকুল্যে মিনিট দশেক। কী আশ্চর্য! সুবীর পালের কারখানায় ঢুকতেই ফের ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। সুবীর হাঁক দিলেন, ‘ওরে সঞ্জয়, মোড়ের মাথার দোকান থেকে আলুর চপ আর মুড়ি নিয়ে আয়। এমন দিনে চপ মুড়ি না হলে আড্ডা জমে নাকি?’ মশা মারার ধূপ জ্বেলে গোল হয়ে বসলেন সকলে। দুগ্গা ঠাকুরের কাঠামো বাঁধতে বাঁধতে মদন পাল বললেন, ‘যা বলবে একটু জোরে বোলো কিন্তু। আমার কানে যেন গল্প এসে পৌঁছয়।’

‘গল্প শুনবে? এমন বাদলা সাঁঝে তবে তেনাদের গল্পই বলি।’ চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে সুবীর শুরু করলেন, ‘কালীপুজোর রাত। খড়দহে আমাদের প্রতিমা গিয়েছিল। দূরের রাস্তা। সেই কারণে আমরাও গিয়েছিলাম ঠাকুরের সঙ্গে। রাস্তার ঝাঁকুনিতে প্রতিমার ছোটখাটো কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। সে সব ঠিক করে রাতেই বাড়ি ফিরছিলাম। তখন আমার একটা মারুতি ভ্যান ছিল। আমিই চালাচ্ছিলাম। সঙ্গে ছিল আরও তিন জন। কল্যাণীর কাছে এক হোটেলে রাতের খাওয়া শেষ করে কিছুটা এগিয়েছি। হঠাৎ ধুপ করে গাড়ির ছাদে কিছু একটা পড়ল। সকলেই চমকে উঠলাম। তারপরে গাড়ির মধ্যে ধূপের গন্ধ। পিছনের সিটে তিন জন বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। সুনসান রাস্তা। একটু ভয় যে পাইনি তা নয়। তারপর ভাবলাম, গাড়ি ছাড়ার আগে তো ধূপকাঠি জ্বালিয়েছিলাম, হয়তো তারই গন্ধ। জানলা খুলে দিলাম। কিন্তু সে আর এক কাণ্ড! গন্ধ কমা তো দূরের কথা, আরও বেড়ে গেল।’

হাতের কাজ থামিয়ে মদন পাল বললেন, ‘কী বলছেন কত্তা! তেনাদেরও কি দেখতে পেয়েছিলেন নাকি?’ তৃষিতের চা জুড়িয়ে জল। অরিন্দমের হাতে আধখাওয়া চপ। মদনের তর সইছে না। তিনি বললেন, ‘ও কত্তা, থামলেন যে? তার পরে কী হল, বলুন।’

সুবীর শুরু করলেন, ‘কোথায় ছিলাম যেন। হ্যাঁ, তো জানলা খুলতে ধূপের গন্ধ আরও বেড়ে গেল। তখন কিন্তু সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। গাড়ি চালাচ্ছি। কিন্তু মনে হচ্ছে গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে কারা যেন উড়ে চলেছে। আর গাড়ির ভিতরে আমরা চার জন ছাড়াও যেন কারা রয়েছে। সারা শরীর দর দর করে ঘামছে। মনে হচ্ছে, গাড়িটা আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। হাওয়ায় ভাসছে। রানাঘাট রেলগেটের কাছাকাছি আসার পরে গন্ধটা বেমালুম উবে গেল। গেট বন্ধ। সামনে দুটো লরি দাঁড়িয়ে আছে। ধড়ে যেন প্রাণ এল! গাড়ি থেকে নেমে বাইরে এসে খোলা হাওয়ায় প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম। পিছনের তিন জন তখন ঘুম ভেঙে আড়মোড়া ভাঙছে। লরির চালকেরা গাড়ি থেকে নেমে চাকা পরীক্ষা করছে। তাঁদের গিয়ে ঘটনাটা বলায় তাঁরা বললেন, ‘বেশ ভয় পেয়েছ মনে হচ্ছে। তুমি বরং আমাদের গাড়ি দু’টোর মাঝে আস্তে আস্তে এসো।’ কৃষ্ণনগরের কাছে পালপাড়া মোড়ে লরি দু’টি থামে। চালকেরা গাড়ি থেকে নেমে বলে, ‘চলার পথে এমন কত ঘটনা ঘটে। দেবতা-অপদেবতা দুই আছে। ধূপের গন্ধ পেয়েছো বলেই কোনও ক্ষতি হয়নি। বদ গন্ধ পেলে বিপদ হতে পারত। অন্ধকার রাস্তায় অনেক সময় গাড়ির উপরে আওয়াজ আমরাও পাই। তেনারা ওঠেন। আবার নেমেও যান। এ সবে আমাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।’ সে রাতে বাড়ি ফিরে ঘুমোতে পারিনি।’ ধূপের গন্ধে ম ম করছে চারদিক। উফ, সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা।’

রাতের বয়স বেড়েছে। বৃষ্টিও থেমে গিযেছে। বাইক চালাতে চালাতে অরিন্দম জিজ্ঞাসা করল, ‘তৃষিত কোনও গন্ধ পাচ্ছিস?’ অরিন্দমের গলাটা কি একটু কেঁপে উঠল!

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE