Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

আজ উল্টোরথ, নবদ্বীপে বিরলদৃষ্ট জগন্নাথ থাকেন নিভৃতেই

নবদ্বীপের পূর্ব প্রান্তে শ্রীবাসঅঙ্গন রোডে এখন যেখানে সমাজবাড়ি মন্দির, সেখানে তখন সে ভাবে বসতি গড়ে ওঠেনি। সামনে গঙ্গা। নদী পাড়ের গাছগাছালি মাঝে নিভৃতে কে কবে গড়ে তুলেছিলেন এক ভজন কুটির সে কথা খেয়ালই করেনি সেকালের নবদ্বীপ।

ব্যতিক্রমী: সমাজবাজির নৃসিংহ মন্দিরে পুজিত হন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার এই বিগ্রহ। নিজস্ব চিত্র

ব্যতিক্রমী: সমাজবাজির নৃসিংহ মন্দিরে পুজিত হন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার এই বিগ্রহ। নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৭ ১২:৫০
Share: Save:

চৈতন্যের প্রভাবেই জগন্নাথ পুজো। জগন্নাথের প্রভাবেই নৃসিংহের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। কিন্তু সেই পুণ্যচর্চায় রয়ে গিয়েছে বাঙালির নিজস্ব লোকাচার।

পুরীর মন্দিরের অধিষ্ঠাতা দেবতা নৃসিংহ। নবদ্বীপে সে দেবতার মন্দির ছিল। যে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন সম্পূর্ণ হাত সহ জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা। কারও হাতে আয়ুধ বা আশ্বাস ভঙ্গি নেই। নেই দান বা দণ্ড।

নবদ্বীপের পূর্ব প্রান্তে শ্রীবাসঅঙ্গন রোডে এখন যেখানে সমাজবাড়ি মন্দির, সেখানে তখন সে ভাবে বসতি গড়ে ওঠেনি। সামনে গঙ্গা। নদী পাড়ের গাছগাছালি মাঝে নিভৃতে কে কবে গড়ে তুলেছিলেন এক ভজন কুটির সে কথা খেয়ালই করেনি সেকালের নবদ্বীপ। তবুও সেখানে নিত্যসেবা হয় সুবৃহৎ নৃসিংহ মূর্তির। দুধসাদা অপূর্ব সে মূর্তি গড়া শ্বেতপাথরে।

এই মন্দিরের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় শতাব্দী প্রাচীন সমাজবাড়ির ইতিহাসে। বৈষ্ণবসাধক রাধারমণ চরণদাস বাবাজি যখন প্রথম নবদ্বীপে আসেন, তিনি উঠেছিলেন জগদানন্দ দাস বাবাজির বাড়ি। তাঁর জীবনীগ্রন্থে জানা যায় জগদানন্দের বাড়ি ছিল ওই নৃসিংহ মন্দির সংলগ্ন। তার বেশ কয়েক বছর পরে নবদ্বীপে সমাজবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। রাধারমণ চরণদাস প্রথম নবদ্বীপে আসেন বাংলার বারো শতকের শেষ দিকে। নৃসিংহও বড় দেবতা বলে স্বীকৃত হয়ে ওঠেন তখন থেকেই। সমাজবাড়ির প্রবীণ সেবাইত রাধাপদ দাস এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, সমাজবাড়ি মন্দির নির্মাণের শুরু বাংলার ১৩১২ সনে। রাধারমণ চরণদাস নবদ্বীপের প্রখ্যাত কাঁসাপিতল ব্যবসায়ী গুরুদাস দাসের বাগানবাড়ির অংশ কিনে সমাজবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু নৃসিংহ মন্দিরের প্রতিষ্ঠা কত সালে? উত্তর মেলে না। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “আঠারো শতকের কোনও একটা সময়ে নৃসিংহ মন্দির প্রতিষ্ঠা হতে পারে। কেননা নবদ্বীপের ইতিহাস বলছে ওই সময় থেকেই গঙ্গার পূর্ব প্রান্তে বসতি পত্তন শুরু হয়েছিল।”

রাধাপদ দাস এই প্রসঙ্গে বলেন “শোনা যায় ওই জগন্নাথ বিগ্রহটি আগে শান্তিপুরে পূজিত হত। পরে তা ভাগবৎ দাস নামে এক বাবাজির মাধ্যমে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল। এর থেকে বেশি তার কিছু আমাদের জানা নেই।” পাশাপাশি, মন্দির সূত্রে জানা গিয়েছে, কোনও এক সময়ে নৃসিংহদেবের সেবাপুজো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে মণীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক ভক্ত জগন্নাথদেবের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। নিঃসন্তান মণীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ বয়সে ওই মন্দিরের দায়িত্ব সমাজবাড়ির আর এক সিদ্ধবৈষ্ণব রামদাসের হাতে তুলে দিয়ে যান। এই ঘটনা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের। তার পর থেকে নৃসিংহ মন্দিরের যাবতীয় দায়দায়িত্ব সমাজবাড়ির। তবে নিত্যসেবা হলেও এই জগন্নাথদেবের রথযাত্রা বের হয় না। এমনকী, নবদ্বীপের খুব বেশি মানুষ জানেনও না তাঁদের শহরে এমন এক বিরলদৃষ্ট বিগ্রহের কথা। শতাব্দী প্রাচীন এক মন্দিরে ততোধিক প্রাচীন জগন্নাথ নীরবে নিভৃতে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE