Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

অভিযোগই করল না হত সিপিএম নেতার পরিবার

শুক্রবার সন্ধ্যায় পঞ্চায়েত ভবনে ঢুকে দুষ্কৃতীরা গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল সিপিএম সদস্য আব্দুল হক শেখকে, তার ২৪ ঘণ্টা পরেও নদিয়ার ফাজিলনগরে তাঁর বাড়িতে পা পড়ল না কোনও সিপিএম নেতার। পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করতে ভরসা পায়নি নিহতের পরিবার। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। কেউ গ্রেফতার হয়নি।

মনোয়ারা বিবি।—নিজস্ব চিত্র।

মনোয়ারা বিবি।—নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৪ ০১:৪৯
Share: Save:

শুক্রবার সন্ধ্যায় পঞ্চায়েত ভবনে ঢুকে দুষ্কৃতীরা গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল সিপিএম সদস্য আব্দুল হক শেখকে, তার ২৪ ঘণ্টা পরেও নদিয়ার ফাজিলনগরে তাঁর বাড়িতে পা পড়ল না কোনও সিপিএম নেতার। পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করতে ভরসা পায়নি নিহতের পরিবার। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। কেউ গ্রেফতার হয়নি।

আব্দুলের স্ত্রী মনোয়ারা বিবি বলেন, “কার ভরসায় অভিযোগ করব বলতে পারেন? দিন-রাত লোকটা পার্টির কাজ করে বেড়াত। বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছি দলই ছিল ওর ধ্যান-জ্ঞান। আর দল ওর জন্য কী করল? দলের একটা লোক পর্যন্ত বাড়িতে এসে খোঁজ-খবরটুকু নিল না।” আব্দুলের মেয়ে রসিদা বিবি বলেন, “এখন পুলিশ-প্রশাসন সবই তো ওদের হাতে। সুবিচার পাব না। উল্টে গ্রামে থাকাও দায় হয়ে যাবে।”

অথচ শুক্রবারই কলকাতায় বামেদের বিক্ষোভ মঞ্চে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভটাচার্য বলেছিলেন, “পুলিশ-প্রশাসন শাসক দলের পাশে রয়েছে। পুলিশ নিজেদের দায়িত্বে ব্যর্থ হলে আক্রান্ত বাম সমর্থকদের নিরাপত্তা দিতে হবে দলকেই।” তারপরেও নিহত ওই নেতার বাড়িতে কেউ গেলেন না কেন? নদিয়ার সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এস এম সাদি যুক্তি দেন, “ওই এলাকার পরিবেশ স্বাভাবিক ছিল না। আমরা গেলে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারত।” তাঁর দাবি, শনিবার সকালে ওখানে নেতারা গিয়েছিলেন। তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বাড়িতে নয়, থানারপাড়া থানায় গিয়েই দায় সেরেছিলেন সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক বিশ্বনাথ ঘোষ, কমলেন্দু সান্যাল ও তেহট্টের বর্তমান বিধায়ক রণজিত্‌ মণ্ডল।

শুক্রবার বিকেলে নদিয়ার থানারপাড়া এলাকায় কুপিয়ে খুন করা হয় স্থানীয় তৃণমূল নেতা আনিসুর রহমান বিশ্বাসকে। তার মিনিট কুড়ি পরেই নারায়ণপুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েত দফতরে ঢুকে গুলি করে খুন করা হয় সিপিএম সদস্য আব্দুল হক শেখকে। শুক্রবার রাতেই আনিসুরের ভগ্নীপতি নজরুল ইসলাম মণ্ডল ২০জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন। ওই ঘটনায় তিন জন গ্রেফতারও হয়ে গিয়েছেন। সেখানে আব্দুল-খুনের অভিযোগও হয়নি।

অথচ এলাকায় যে সিপিএম একান্ত দুর্বল, এমন নয়। নারায়ণপুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েত-সহ করিমপুর ২ ব্লকের মোট ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৬টি সিপিএম-এর দখলে। করিমপুর ২ পঞ্চায়েত সমিতিও সিপিএমের দখলে। তেহট্টের বিধায়কও সিপিএমের। ফাজিলনগর গ্রামের ছয়-সাতজন পঞ্চায়েত সদস্য সিপিএমের। এহেন ‘শক্ত’ জমিতে দলীয় নেতা খুন হলে পাশে যদি দলকে না পাওয়া যায়, তাহলে কর্মীরা কাজ করবেন কোন মনোবলে, সেই প্রশ্ন উঠছে। স্থানীয় এক সিপিএম সমর্থক বলেন, “যখন মাওবাদী ও দক্ষিণপন্থীদের হাতে একের পর এক খুন হয়েছেন বাম নেতা-কর্মীরা, তখনও প্রাণের ঝঁুকি নিয়ে দল করে গিয়েছেন আব্দুলভাই। অথচ খুন হওয়ার পর তাঁর লাশ মর্গে নিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের লোক খুঁজে বেড়াতে হয়েছে।”

সিপিএম সমর্থকদের ক্ষোভ আরও বেড়েছে, নিহত আনিসুরকে ঘিরে তৃণমূলের তত্‌পরতা দেখে। শুক্রবার আনিসুর খুন হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িতে চলে আসেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা। বাড়ির সামনে বসানো হয়েছে পুলিশ পিকেট। শনিবার সকালেও দেখা গেল, বাড়ির সামনে সমর্থকদের ভিড়। অন্য দিকে আব্দুল হকের বাড়িতে কেউ নেই, শুধুই কান্নার রোল।

একই ফারাক দেখা গিয়েছে কৃষ্ণনগর মর্গেও। শনিবার সকাল থেকেই একে একে মর্গে চলে আসেন জেলার তৃণমূল কার্যকরী সভাপতি তথা শান্তিপুরের বিধায়ক অজয় দে, জেলা পরিষদের সভাধিপতি বাণীকুমার রায়, কৃষ্ণনগরের পুরপ্রধান অসীম সাহা প্রমুখ নেতারা। পরে আসেন মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাসও। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা মর্গ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে, বেলা দু’টো নাগাদ কৃষ্ণনগর মর্গে পৌঁছন সিপিএম নেতা এস এম সাদি, অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তনু ঝা, আরএসপি-র শঙ্কর সরকার।

আক্রান্তদের পাশে নেই দল, সেই ক্ষোভেই নানা জেলায় সিপিএম থেকে বিজেপি-তে যাচ্ছেন সমর্থকরা। লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পরে নারায়ণপুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিএমের প্রধান ও উপপ্রধানের স্বামী বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। প্রধান আলতফান হালসানার স্বামী পল্টু এদিন বলেন, “আমার স্ত্রী এখনও সিপিএম করলেও আমি বিজেপিতে যোগ দিয়েছি। তার একটাই কারণ, সিপিএম এখন আর কর্মীদের আপদ-বিপদে পাশে থাকছে না। আব্দুল ভাই খুনের পরে তা আরও স্পষ্ট হয়ে গেল।” শনিবারই কৃষ্ণনগরে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন নদিয়ার নানা গ্রাম পঞ্চায়েতের ১১জন সিপিএম সদস্য-সহ দলের বেশ কিছু কর্মী-সমর্থক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE