মিনিকিটের বীজতলা তৈরির কাজ চলছে। গোপালপুরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
খরিফ মরসুমেও মিনিকিট বা সরু ধানের চাষ বাড়ছে নদিয়া জেলায়।
কয়েক বছর আগেও কৃষকরা কেবল মাত্র বোরো মরসুমেই সরু ধানের চাষ করতেন। কিন্তু প্রচলিত সেই ধারণা বদলে যাচ্ছে ক্রমশ। ফলনে কম সময়, সর্বোপরি চাহিদা বেশি বলে সরু ধানের চাষ বাড়ছে। এ বার নদিয়ার দক্ষিণ ভাগে অর্থাৎ রানাঘাট-কল্যাণী মহকুমা এলাকায় অর্ধেকেরও বেশি জমিতে সরু ধানের চাষ হচ্ছে। তবে জেলার উত্তর দিকে কৃষ্ণনগর-তেহট্ট মহকুমাতে কিন্তু এখনও মোটা ধানের চাষ অপেক্ষাকৃত বেশি। জেলার উপ-কৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) বিকাশচন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘‘শুধু দাম বেশি পাওয়ার জন্যই নয়। আরও নানা কারণে এখন আমাদের জেলার কৃষকরা আমন বা খরিফ মরসুমেও সরু ধানের চাষ করতে উৎসাহিত হচ্ছেন। বছর বছর তার পরিমাণ বাড়ছে।’’
কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গত বছর নদিয়া জেলার ৮৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছিল। এই বছর সেটা বাড়িয়ে লক্ষ্যমাত্রা করা হয়েছে প্রায় এক লক্ষ হেক্টর জমি। এর মধ্যে নদিয়া জেলার দক্ষিণ ভাগে অর্থাৎ রানাঘাট-কল্যাণী মহকুমা এলাকায় প্রায় ৬৫ শতাংশ জমিতেই সরু চালের ধান চাষ হচ্ছে। যেখানে এই এলাকায় সাত বছর আগেও মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ জমিতে এই ধান চাষ হত।
নদিয়া জেলায় সরু ধানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় শতাব্দী ধান। এছাড়াও প্রতীক্ষা বা বাঁশকাঠি ধানের চাষও হয়। কিন্তু তার পরিমাণ অনেকটাই কম। আর মোটা ধানের মধ্যে স্বর্ণ অর্থাৎ লালস্বর্ণ ও সাদাস্বর্ণের চাষই হয় সিংহভাগ। মোটা ধান চাষে বেশি সময় লাগেপ্রায় ১৪০ থেকে ১৪৩ দিন। সেখানে সরু ধান বা মিনিকিট চাষ করতে সময় লাগে অনেকটাই কম১১০ থেকে ১২০ দিন। খরিফ মরসুমে মিনিকিট চাষে চাষিদের উৎসাহিত হওয়ার এটা একটা বড় কারণ। কৃষকরা জানিয়েছেন, সরু ধান আগে উঠে যাওয়ায় সেই জমিতে সর্ষে চাষ করা যায় ফের। মোটা বা স্বর্ণ ধান চাষ করলে সেই সুযোগটা আর থাকে না। জমি পড়ে থাকে বোরো মরসুম পর্যন্ত। পুরাতন চাপড়ার বাসিন্দা সুফিয়ার রহমান মণ্ডল বলেন, “র্সষে ছাড়াও আমি বাকি জমিতে আলু ও মটরশুঁটি চাষ করতে পারব ওই সময়টা। এবারও তাই তিন বিঘা জমিতে মিনিকিট বা সরু ধানের চাষ করছি।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, যে সব কৃষকের একটু উঁচু জমি আছে, তাঁরা বেশিরভাগই খরিফ মরসুমে মিনিকিট বা সরু ধানের চাষ করছেন। গত চার বছর ধরে শতাব্দী ধান চাষ করছেন হাঁসখালির গোপালপুরের বাসিন্দা নিমাই মণ্ডল। এক বিঘা জমির পুরোটাতেই সরু ধান চাষ করছেন তিনি। নিমাইবাবু বলেন, ‘‘আগে আমার জমিতে স্বর্ণ ধান চাষ করতাম। তাতে সময় বেশি লাগত। ফলে সেই জমিতে আর কিছু চাষ করতে পারতাম না। বোরো মরসুম পর্যন্ত তিন মাস সেই জমি পড়ে থাকত। এখন সেটা হয় না। মাঝখান থেকে সর্ষে চাষ করে বেচে পয়সা পাচ্ছি।’’ অনেকে আবার আমনের মরসুমে সরু ধানের চাষ করেন পরের মরসুমে বীজের চাহিদা মেটাতে। আ্যাসোসিয়েশন অফ নদিয়া জেলা ফার্মাস ক্লাবের সম্পাদক নিমাইবাবু বলেন, ‘‘আমরা এবারই ৫০ জন কৃষককে দিয়ে ৭০ বিঘা জমিতে সরু ধানের চাষ করাচ্ছি। এই ধান যেমন খাওয়ার জন্য বিক্রি হবে তেমনই কিন্তু আমরা বোরো মরসুমের চাষের জন্য বীজ হিসাবে রেখে দেব।”
তবে সাধারণ ভাবে মোটা ধানের থেকে সরু ধানের ফলন কিছুটা হলেও কম। আরংডাঙার বাসিন্দা হলধর মণ্ডল বলেন, ‘‘ফলন একটু কম হলেও চাহিদা বেশি। তাই দামটা যে বেশি। তাছাড়াও খরচটাও কম। বিক্রির জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না। স্থানীয় বাজারেই এর চাহিদা আছে। বাড়িতে রেখে দিয়ে নিজের সময় মতো সহজে বিক্রি করা যায়।’’
অর্থাৎ বাজারটাও সরু ধান চাষ বাড়ার অন্যতম কারণ। মোটা ধানের দাম যেমন কম তেমনই বেচার ক্ষেত্রে বাজারটা অনেক ছোট। সরু চালের যেখানে স্থানীয় বাজার আছে সেখানে কিন্তু মোটা চালের তেমন কদর নেই। এই চাল সাধারণত ফড়ের মাধ্যমে চলে যায় বিভিন্ন আড়তে। সেখান থেকে শিলিগুড়ি কিংবা ভিন্ রাজ্যে যায়। কিছুটা কেনে সরকার। এছাড়া চিড়ে কলে চাহিদা আছে কিছুটা।
এই সব কারণে ক্রমশই বাড়ছে সরু ধান চাষের প্রবণতা। শুধু রানাঘাট ২ ব্লকেই এই মরসুমে গতবারের তুলনায় সরু ধান চাষ প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্লক কৃষি আধিকারিক জেসমিন হক। তিনি বলেন, “আমন মরসুমে মিনিকিটের চাষ গতবারের তুলনায় এই বছর প্রায় দ্বিগুণ। এবার আমাদের ব্লকের ৪ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হচ্ছে। তার প্রায় ৬৫ শতাংশ জমিতে শতাব্দী বা প্রতীক্ষার মতো সরু চালের ধান চাষ হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy