সেমুই ছাড়া খুশির ঈদ! যেন ‘চিকেন ছাড়া চিকেন রোল’। তেমনটা আবার হয় নাকি?
মরসুমি ফলের মতো মাস খানেকের জন্য সেমুইয়ের আর্বিভাব বাজারে। তাতেই বাজিমাত। কমলা-হলুদ-সাদা, সরু-মাঝারি-মোটাহাজারো রকমের সেমুইয়ের চাকে এই সময়টা ছেয়ে যায় বাজার। দর্শনেই অর্ধভোজন।
একটা সময় ছিল যখন ঈদের সময় বাড়িতেই তৈরি হত সেমুই। সম্পন্ন মুসিলম পরিবারে সেমুই তৈরির জন্য কাঁসা পিতল দিয়ে তৈরি হাতে ঘোরানো মেশিন থাকত। রোজার মাসে সেই মেশিন বিভিন্ন বাড়িতে ঘুরে বেড়াত সেমুই তৈরির জন্য। বাড়ির মহিলারা হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেমুই তৈরি করতেন। তারপর তা রোদে শুকোতে দেওয়া হত। উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত অনেক আগেই।
দিন বদলেছে। নিজের বাড়িতে সেমুই তৈরি করার পদ্ধতি এখন আর চোখে পড়ে না। বিহার, কলকাতা, বীরভূম এমনকি মুর্শিদাবাদেও তৈরি হয়েছে সেমুই কারখানা। ব্যবসায়ীদের দেওয়া হিসাব অনুসারে শুধু রমজান মাসেই মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রায় ৫ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। আবার এই ৫ কোটির মধ্যে প্রায় ৪ কোটি টাকার ব্যবসা হয় ঈদের আগের তিন দিনে। সেমুই তৈরিতে মাস খানেকের জন্য শ্রমিকদেরও লাভজনক মজুরির কাজ জোটে।
মূলত রুল ময়দা দিয়ে সেমুই তৈরি করা হয়। তিন ধরণের সেমুই পাওয়া যায়--- লাচ্চা, কাঠি ও জিরো। লাচ্চা সেমুই মেসিনে অথবা হাতে তৈরি করা হয়। বহরমপুরের ফল ও সেমুই ব্যবসায়ী সুকুমার দে বলেন, “ঘিয়ে ভাজা হাতলাচ্চার মতো সুস্বাদু সেমুই আর হয় না।”
দুধে কাজু, কিসমিস, জয়ত্রি, চিনি দিয়ে উনুনে জ্বাল দিতে হয়। দুধ-চিনির সেরা তৈরি হয়ে গেলে তাতে লাচ্চা সেমুই ডুবিয়ে দেওয়া হয়। কয়েক মিনিট ভেজানো থাকলে সেই সেরা শুষে নেবে লাচ্চা। তারপর সামান্য গোলাপজল ছিটিয়ে প্লেটে পরিবেশন করা হয়। আর স্বাদের কথা, লিখে কী তা বর্ণনা করা যায়?
কাঠি সেমুই ও জিরো সেমুই মূলত ভোনা রান্না হয়। ভোনা মানে শুকনো শুকনো। তবে কাঠি সেমুই লাচ্চার মতো রসালোও রান্না করা যায়। কাঠি ও জিরো--- দু’ ধরণেই সেমুই মেসিনে তৈরি করা হয়। পামতেলে, ডালডায় অথবা ঘিয়ে ভাজা হয়। আবার না-ভাজা, অর্থাৎ কাঁচাও পাওয়া যায়। সরু সুতোর মতো লম্বা লম্বা দেখতে কাঠি সেমুই। জিরো সেমুই হয় তার থেকেও সরু।
রোজার জন্য মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে অস্থায়ী ছোট কারখানা। ধুলিয়ান, অরাঙ্গাবাদ, সমসেরগঞ্জ, বড়োঞা-ডাকবাংলো, সালার, বেলডাঙা, ইসলামপুর, বালিরঘাট, দৌলতাবাদ ও বহরমপুরের উত্তরপাড়া, জমিদারি, হরিদাসমাটি, বৈরগাছির মতো এলাকাতে গেলেই দেখা যায় সার দিয়ে তৈরি হচ্ছে সেমুই। তবে এই সব কারখানার আয়ু মোটে মাসখানেক। ভাগীরথীর পশ্চিমপাড়ে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সেতু লাগোয়া নিয়াল্লিশপাড়া-উত্তরপাড়ায় গড়ে উঠেছে এরকম একটি কারখানা। মালিক বরুণ ঘোষ আদতে ফল ব্যবসায়ী। তাঁর বাড়ির ছাদের উপর তারপলিন টাঙিয়ে মাসখানেক ধরে চলছে সেমুই তৈরির কাজ।
মুশির্দাবাদের সালার থেকে প্রতি বছর কিছু মানুষ আসেন সেমুই তৈরি করতে। আবার কেউ কেউ আসেন বিহার থেকে। বরুণবাবু বলেন, “সালার থেকে ১৫ জন শ্রমিক এসেছে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টায় তাঁরা দৈনিক সাড়ে ৫ কুইন্টাল ময়দা থেকে ৮ কুইন্টাল লাচ্চা উৎপাদন করেন। প্যাকেট বন্দি হয়ে সেই সেমুই মুর্শিদাবাদ জেলা ছাড়াও চলে যাচ্ছে বীরভূম ও নদিয়ায়।”
ফল ও সেমুই ব্যবসায়ী সুকুমারবাবু বলেন, “কলকাতা, সিউড়ি, সাঁইথিয়া থেকেও এ জেলায় সেমুই আমদানি হয়। ধরণ ও গুণমানের রকম ফের অনুসারে খুচরো বাজারে সেমুই বিকোচ্ছে ৬০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy