এ বারের ঈদটা অন্য রকম ওঁদের কাছে। এক মাসের রোজা শেষে ওঁরাও বাড়ির পুরুষদের মতোই গ্রামের ঈদগাহে যাবেন নমাজ পড়তে। একে অপরকে আলিঙ্গন করে শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন।
নদিয়া জেলায় এই প্রথম মহিলারা সার বেঁধে ঈদ-উল-ফিতরের নমাজ পড়বেন। পাড়ার জনা কয়েক যুবকের উদ্যোগে কৃষ্ণনগরের চাঁদসড়কপাড়ার মহিলারা মঙ্গলবার সকালে নমাজ পড়বেন।
ইসলামি ধর্ম বিধান অনুযায়ী দলবদ্ধ ভাবে মহিলাদের নমাজ পড়ার ক্ষেত্রে কোনও বিধি নিষেধ নেই। কিন্তু যুগ-যুগান্তর ধরে ঈদের দিন সকালে মহিলারা বাড়ির পুরুষদের জন্য সুস্বাদু সব খাবার তৈরি করবেনএই রীতিই চলে আসছে। অবশ্য এই নিগড় রাজ্যের কোথাও কোথাও যে ভাঙেনি তা নয়। বীরভূমের বেশ কিছু অঞ্চলে মহিলারা ঈদের নমাজে অতীতে অংশগ্রহণ করেছেন। বছর সাতেক আগে বীরভূমের মুরারইয়ের জনা ষাটেক মহিলা গ্রামেরই একটি ঘেরা জায়গায় একত্রিত হয়ে ঈদের নমাজ পড়েন। কিন্তু বছর দু’য়েক পরেই ঘেরা অথচ প্রকাশ্য কোনও জায়গা না মেলায় ওই মহিলাদের উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যায়। ওই জেলারই মারগ্রামে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী নুরে আলম চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী সঙ্ঘমিত্রা চৌধুরীর উদ্যোগে মহিলারা ঈদের নমাজে অংশ নেন। ২০০৮ সাল থেকে ওই নমাজ এখনও চলছে। মসজিদ চত্বরে দাঁড়িয়ে সেখানে মহিলারা নমাজ পড়েন। যদিও গ্রামের সকল মহিলাই নমাজে যোগ দেন না। নমাজের সারিতে কোনও বছরই মহিলাদের সংখ্যাটা তিন অঙ্কে পৌঁছয় না।
নদিয়া জেলায় এই উদ্যোগ অবশ্য এবারই প্রথম। ভাবনাটা শুরু হয়েছিল আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে। চাঁদসড়ক পাড়ার কিছু যুবক কর্মসূত্রে মধ্যপাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকতেন। সেখানে দুই ঈদে মহিলারা একত্রে নমাজ পড়েন। এলাকার যুবক সাবির আলি শেখের কথায়, “বেশ কয়েক বছর দুবাইয়ে রান্নার কাজ করেছি। ওখানে মহিলাদের নমাজ পড়ার ক্ষেত্রে কোনও বিধিনিষেধ নেই। তাই গত বছরই মনে হয়েছিল এলাকাতে মহিলাদের ঈদের নমাজ চালু করা যায় কিনা।” কিন্তু গত বছর এলাকার লোকজন সর্ব সম্মতিক্রমে এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। চলতি বছরে মাস খানেক আগে থেকেই সাবিরের নেতৃত্বে এলাকায় জনমত তৈরির কাজ শুরু হয়। শেষমেশ সকলের ইচ্ছাতেই ঠিক হয়, এ বার পাড়ার ঈদগাহ-মসজিদে সকাল সাতটায় শুরু হবে মহিলা পরিচালিত ঈদের নমাজ। সেই উপলক্ষে সোমবার সন্ধ্যা থেকেই আলো ও ফুলের মালায় সাজানো হয়েছে ওই ঈদগাহ। মহিলাদের পাশাপাশি বাড়ির পুরুষরাও এ কাজে হাত লাগিয়েছেন। শুধু সিদ্ধান্ত নিয়েই ক্ষান্ত হননি এলাকার যুবকরা। মহিলাদের বেশি সংখ্যায় যোগদান সুনিশ্চিত করতে প্রচার শুরু করেছেন তাঁরা। নমাজে হাজির থাকার আমন্ত্রণ জানিয়ে দিন সাতেক ধরেই বাড়ি-বাড়ি প্রচার করেছেন তাঁরা। এ ছাড়াও সোমবার দিনভর এলাকায় মাইকে করে প্রচার করা হয়েছে। তবে কেবলমাত্র চাঁদসড়কপাড়াতেই এই প্রচারাভিযান চলেছে। শহর ও শহরতলির অন্যত্র মহিলাদের কেন ঈদগাহে হাজির হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হল না? সাবিরের কথায়, “বহু বছরের পুরোনো এই মসজিদে সাকুল্যে শ’দুয়েক লোক নমাজ পড়তে পারেন। তাই আমরা পাড়ার মহিলাদের মধ্যেই প্রচার করছি।”
সোমবার ইফতারের পরপরই রাত পোহালে ঈদের নমাজে হাজির থাকার আনন্দে আত্মহারা পাড়ার মহিলারা। সন্ধ্যা থেকেই মহিলারা হাতে মেহেন্দি পড়তে শুরু করেছেন। সকলের মধ্যেই একটা চাপা উত্তেজনা। এত বছরের আগল ভাঙার আনন্দ। পম্পা বিবি, চায়না বিবিরা পাড়ার মহিলাদের জড়ো করে ঈদের নমাজের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করছেন। পম্পা বিবি উত্তেজিত ভাবে বললেন, “সারা জীবন ঈদের দিন সকালটা ঘর-গেরস্থালীর কাজ করেই কেটেছে। এ বার বেরনোর সুযোগ পেয়ে ভাল লাগছে।” চাঁদসড়কপাড়ার এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ইমাম-মোয়াজ্জেন কল্যাণ সমিতির নদিয়া জেলার সভাপতি হাজি লুৎফার রহমান বলেন, “ধর্ম মহিলাদের এক সঙ্গে নমাজ পড়তে নিষেধ করেনি। চাঁদসড়কপাড়ার লোকজনের এই উদ্যোগ সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। আশা করি এরপর অন্য জায়গার মহিলারাও ঈদের নমাজে যোগ দেবেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy