চালু হয়নি। নশিপুর-আজিমগঞ্জ রেলসতু তাই সাইকেলেই পারাপার এলাকাবাসীর। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।
সেতু হয়ে গিয়েছে বছর পাঁচেক আগে। সেতুতে ওঠার রেলপথও এক দিকে তৈরি। জমি জটে আটকে অন্য পাড়ের কাজ। জমি আন্দোলনের গেরোয় আজও চালু হল না ভাগীরথীর উপর নশিপুর-আজিমগঞ্জ রেলসেতু। মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রথম ট্রেন চলেছিল ১৮৬৩ সলের ২১ ডিসেম্বর আজিমগঞ্জ-নলহাটি রেলপথে। দুর্ভাগ্য, আজ সেই আজিমগঞ্জেই আটকে আছে রেলসেতুর কাজ।
ভাগীরথীর পশ্চিম পাড় বরাবর চলে গিয়েছে পূর্ব রেলের হাওড়া ও মালদহ বিভাগের রেল লাইন। শিয়ালদহ বিভাগের লালগোলাগামী রেললাইন ভাগীরথীর পূর্ব পাড় বরাবর গিয়ে থমকে গিয়েছ পদ্মাতীরে। প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বরাবর সমান্তরাল বয়ে যাওয়া রেলপথ দু’টি সংযুক্ত রয়েছে এক মাত্র নৈহাটি-ব্যান্ডেলে। মুর্শিদাবাদ ও নদিয়ার মানুষকে দিল্লি বা উত্তর-পূর্ব ভারতে যেতে হলে তাই ট্রেন ধরতে উজিয়ে যেতে হয় শিয়ালদহ ও হাওড়ায়। যাওয়া-আসা মিলে ২০ থেকে ২৪ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় ও অর্থ ব্যয় হয়। পূর্ব পাড়ে নশিপুর ও পশ্চিম পাড়ে আজিমগঞ্জে রেলসেতু থাকলে ব্যান্ডেলের পর রেলের দুই বিভাগ—শিয়ালদহ ও হাওড়ার মধ্যে সংযুক্তি ঘটবে ফের। সময় ও অর্থ দু’টোই সাশ্রয় হবে তাতে। অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জিয়াগঞ্জের কিশোর রায় চৌধুরীর মতে, “ভাগীরথীর উপর রেলসেতু চালু হলে লালবাগ ও জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের পযর্টন শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের সমূহ উন্নতি ঘটবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বাড়বে।” লালবাগের রৌশনবাগে রয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ৩টি ব্যাটেলিয়ানের স্থায়ী কার্যালয় ও ছাউনি। নদীর অপর পাড়ে নবগ্রামে সেনা ছাউনি নির্মাণের কাজ চলছে। ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তার প্রয়োজনেও ওই রেলসেতুর প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
সেতুর ভাবনাটা অবশ্য প্রথম মাথায় এসেছিল সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত নায়েক আবদুর রউফ খানের। লালবাগে বাড়ি তাঁর। ভাগীরথীর বুকে রেলসেতুর পরিত্যক্ত দু’টি বিশাল পিলার দেখে কৌতুহলী হয়ে তিনি এর পিছনের কাহিনি খোঁজা শুরু করে দেন। অবশেষে মুর্শিদাবাদ জেলা রেলওয়ে প্যাসেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশানের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রউফ খান পেয়ে যান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের পূর্বরেলের মানচিত্রের মতো একটি ‘পরশ পাথর’। মানচিত্র অনুসারে, নদীর বুকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা বিশালাকৃতি পিলার দু’টি আসলে রেলসেতুর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক প্রয়োজনে ব্রিটিশরাজ রেলসেতু নির্মাণ করেছিলেন। ওই মানচিত্র অনুসারে, আজিমগঞ্জ-ফরাক্কা হয়ে রেলপথটি চলে গিয়েছে দিল্লি ও উত্তর-পূর্ব ভারতের দিকে।
এরপরই লালবাগ, জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ তথা সমগ্র মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া জেলার পর্যটন শিল্প, অর্থনীতি ও রেলপথ-পরিবহণ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতির অবলম্বন হিসাবে পিলার দু’টিকে আঁকড়ে ধরেন আবদুর রউফ খান। এই আন্দোলনে ক্রমে যোগ দেয় জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি, মুর্শিদাবাদ জেলা চেম্বার অফ কর্মাস-সহ বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠন। মুর্শিদাবাদ জেলা চেম্বার অফ কমার্সের যুগ্ম সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য ও জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক অরুণ সাহা বলেন, “জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ এবং লালবাগ তো বটেই, সেতুটি তৈরি হলে পর্যটন শিল্প-সহ প্রতিবেশী দুই জেলার বহুমুখী উন্নতি হবে। সেই ভাবনায় মুর্শিদাবাদ জেলা রেলওয়ে প্যাসেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যৌথ ভাবে আন্দোলন করেছি। জিয়াগঞ্জ স্টেশনে একদিন টানা ১৭ ঘণ্টা রেল অবরোধও করা হয়।” একই দাবিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির তরফে সংসদের ভিতরে ও বাইরে আন্দোলন গড়ে ওঠে।
অবশেষে ২০০৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর তৎকালীন রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রস্তাবিত রেলসেতুর শিলান্যাস করেন। অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে দুই মন্ত্রী ঘোষণা করেন, সেতু নির্মাণ করে ৩ বছরের মধ্যে রেল চালানো হবে। নদীর বুকে প্রায় ৫০০ মিটার দীর্ঘ সেতু ও দু’পাড়ের সংযোগকারী পথ মিলে মোট সাড়ে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৪৬ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা।
রেলসেতু নির্মাণ হয়েছে। জমিজটে আটকে রয়েছে সেতুতে ওঠার রেলপথ। তাতে কি! জমি আন্দোলনে একসময় পথ দেখিয়েছিলেন যিনি সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১০ সালে রেলমন্ত্রী থাকাকালীন হাজারদুয়ারি-লালকেল্লা এক্সপ্রেস ভায়া মুশির্দাবাদ (লালবাগ) কলকাতা নামের একটি ট্রেন বরাদ্দ করেন। তা নিয়ে বিস্তর হাসির খোরাক তৈরি হয়।
হাসির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আজিমগঞ্জ-নসিপুর রেলসেতুর কপাল পোড়ার কাহিনিও। নির্মিত রেলসেতুর পূর্বপাড়ের জমি নিয়ে জটিলতা না থাকলেও পশ্চিমপাড়ের জমি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন। ওই সময় হাতের কাছে টাটকা ইস্যু পেয়ে সিপিএম এবং ফরওয়ার্ড ব্লক সিঙুর-নন্দীগ্রামের বদলা নেয় আজিমগঞ্জের মাহিনগরে। ২১ বিঘা জমির ১০৩ জন মালিক বামফ্রন্টের ছাতার তলায় ভিড়ে গিয়ে ‘চাকরি না পেলে জমি নয়’ দাবি তুলে আন্দোলন শুরু করেন। তাঁরা এখানেই থেমে থাকেনি। জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের পুরপ্রধান তথা সিপিএমের জোনাল কমিটির সদস্য শঙ্কর মণ্ডল ও জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক অরুণ সাহা বলেন, “জমির বিনিময়ে চাকরি পেতে বছর তিনেকের মধ্যে মূল মালিক তাঁর বংশধরদের নামে জমি বণ্টননামা রেজিস্ট্রি করে দেয়। ফলে ১০৩ জনের বদলে জমির মালিক এখন ৪১৭ জন।”
রেলমন্ত্রীর কুর্সি বদলের সঙ্গেই জমির মালিকদেরও রাজনৈতিক ছাতা বদলেছে। জিয়াগঞ্জের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব সমীর ঘোষ জানান, রেলমন্ত্রী থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পদত্যাগ করার পর মাহিনগরের জমি মালিকরাও রাজনৈতিক আনুগত্য বদল করে ভিড়ে গিয়েছেন তৃণমূলের ছাতার তলায়। যোগ্যতা অনুসারে চাকরির লিখিত প্রতিশ্রুতি ছাড়াও ক্ষতিপূরণ ও দাম বাবদ খেতিজমির জন্য একর প্রতি দেওয়া হচ্ছে ১৮ লক্ষ ৬৩ হাজার টাকা। ভিটে জমির জন্য একর প্রতি দাম ধার্য হয়েছে ২২ লক্ষ ৪৭ হাজার টাকা। তবু ‘আরও চাই।’
এরই মধ্যে কিছুটা আশার আলো শোনালেন লালবাগ মহকুমাশাসক প্রবীর চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “ইতিমধ্যে ২১০ জন জমির মালিক দাম ও ক্ষতিপূরণ বাবদ চেক নিয়েছেন। ধীর গতি হলেও জমিজট খুলছে। আরও ১১ জন কয়েক দিনের মধ্যে চেক নিতে পারেন। বাকিদের সঙ্গেও আলোচনা চলছে।”
শাপমোচনে এই আলোচনাটুকুই ভরসা জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-নদিয়া মুর্শিদাবাদ’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, নদিয়া মুর্শিদাবাদ বিভাগ, জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy