মোহ ও দারিদ্রের কাছে বারবার হার মানতে হচ্ছে ওদের। বাইরে ভাল কাজ, মোটা টাকা মাইনের প্রলোভনে বেলডাঙার সুতিহাটার বেশ কয়েকজন মেয়ে ঘর ছেড়েছে। তারপর কেউ ফিরে এসেছে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে। কারও আবার এখনও পর্যন্ত কোনও খোঁজই পাওয়া যায়নি। শুক্রবার ‘মাসী’র সঙ্গে মুম্বইয়ের পথে পা বাড়িয়েছিল সুতিঘাটা গ্রামের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রুবিনাও (নাম পরিবর্তিত)। তবে এক সহযাত্রীর সাহায্যে কৃষ্ণনগর থেকে তাকে উদ্ধার করে নদিয়া জেলা প্রশাসন। নদিয়ার জেলাশাসক ওই ছাত্রীর ইচ্ছের কথা শুনে তাকে এক আবাসিক স্কুলে ভর্তিরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ঘটনার পরে ওই ছাত্রীর গ্রামের লোকজন ও জেলা প্রশাসনের কর্তারাও মেনে নিয়েছেন যে খুব অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে ওই ছাত্রী।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই গ্রাম থেকে এই ভাবে প্রায় দশ জন মেয়ে বাইরে ‘কাজে’ গিয়েছে। রুবিনার পরিবারেও টনটনে অভাব। বছর দুয়েক আগে তার এক দিদিও মুম্বইয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার কোনও খোঁজ মেলেনি। রুবিনার মা বলছেন, “গ্রাম থেকে দু’কিলোমিটার দূরে পুলিন্দা বালিকা বিদ্যালয়ে মেয়ে পড়ত। স্কুলের পোশাক পরে স্কুলের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। তারপরে কী করে যে এমন কাণ্ড ঘটে গেল বুঝতে পারছি না। খুব কষ্ট করে হলেও মেয়েকে পড়াচ্ছিলাম। এখন সরকার যদি ওর একটা ব্যবস্থা করে তাহলে তো ভালই।”
সারগাছির কাছে সুতিঘাটায় ১৩০০ লোকের বাস। যাতায়াতের রাস্তা বেহাল বললেও কম বলা হয়। শিক্ষার হার মেরেকেটে ১৫ শতাংশ। গ্রামের বহু মানুষের রেশন কার্ড নেই। নেই বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা। গ্রামের বেশিরভাগ লোকজন দিনমজুর। এই নেই রাজ্যে একমাত্র আশার আলো দেখাচ্ছে স্থানীয় সুতিহাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়। বেশ কয়েক মাস আগে থেকে গ্রামের এই অবস্থা দেখে স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুল পড়ুয়াদের নিয়ে নাবালিকার বিয়ে ও নারী পাচার বিরোধী আন্দোলন শুরু করেছে। স্কুলের প্রধানশিক্ষক হিলালউদ্দিন বলছেন, “আমরা স্কুলে নাটক করে, নানা রকম গল্প বলে আমরা পড়ুয়াদের সচেতন করছি। কথা বলছি গ্রামের মানুষের সঙ্গেও।” তাঁর দাবি, পড়ুয়াদের পাশাপাশি গ্রামের মানুষও সচেতন হচ্ছেন। শিক্ষার হারও বাড়ছে। এই বছরেই ওই গ্রাম থেকে এক মহিলা প্রথম স্নাতক হয়েছেন। তবে সামগ্রিক ভাবে অবস্থার বদল হতে আরও সময় লাগবে। সেই সঙ্গে হিলালউদ্দিনও স্বীকার করছেন, “দারিদ্র ও মোহের প্রলোভনের কাছে কখনও কখনও হেরে যাচ্ছে সচেতনতাও। তবে আমরাও হাল ছাড়ছি না।”
ওই শিক্ষকের কথা যে কথার কথা নয় সেটা টের পাওয়া গেল ওই স্কুলেরই কয়েকজন ছাত্রীর বক্তব্যেও। গ্রামের রিম্পা খাতুন, সনিয়ারা খাতুনরা সমস্বরে বলছে, ‘‘আমরা কোনও ফাঁদে পা দেব না। কেউ জোর করলে পুলিশকে ১০০ নম্বরে ফোন করব। এ সব আমাদের মাস্টারমশাইরা শিখিয়েছেন।” আর এ বছরেই ওই গ্রাম থেকে প্রথম স্নাতক হওয়া আবিদা সুলতানা বলছেন, “আমিও খুব গরিব পরিবারের মেয়ে। এত অভাবের মধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সত্যিই খুব কঠিন। তবে এটাও বুঝতে পেরেছিলাম যে, একমাত্র পড়াশোনাই পারে এই সব সমস্যার সমাধান করতে। এখন আমি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসে স্বনির্ভর হচে চাইছি।” আবিদা জানান, দারিদ্রের সুযোগ নিয়েই কিছু মানুষ গ্রামের মেয়েদের বাইরে কাজে নিয়ে যাচ্ছে। নাবালিকার বিয়েও এই গ্রামে নতুন কিছু নয়। এসবের বিরুদ্ধে স্থানীয় ওই প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নানা ভাবে পড়ুয়া ও গ্রামবাসীদের সচেতন করছেন। তবে ওই প্রবণতা একেবারে বন্ধ হতে আরও সময় লাগবে।
বেলডাঙা ১ বিডিও শুভ্রাংশু মণ্ডল বলেন, “প্রশাসনের তরফে ওই গ্রামে সবরকম সাহায্য করা হবে। কাজের টোপ দিয়ে কোনও মেয়েকে যাতে কেউ বাইরে না নিয়ে যেতে পারে সে দিকেও আমরা পুলিশকে কড়া নজর রাখতে বলা হয়েছে।” জেলার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষে বিভাস সরকার বলেন, “ওই স্কুল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে সুতিহাটায় সচেতনতা আরও বেড়েছে। তবে স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত ও প্রশাসনেরও এই বিষয়ে আরও সক্রিয় হওয়া দরকার।” নদিয়ার জেলাশাসক পি বি সালিম বলেন, “আমরা পুরো বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েছি। তারা তদন্তও শুরু করেছে। তবে আবাসিক স্কুলে ভালই আছে রুবিনা। ওর যাতে কোনওরকম অসুবিধা না হয় সে দিকে নজর রাখা হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy