চাপড়া কলেজে পরিচালন সমিতির বৈঠক।—নিজস্ব চিত্র।
সত্তরের দশক মনে পড়িয়ে দিল কি বাঙালঝি কলেজ?
চাপড়ার ওই কলেজে নকল করতে দেওয়ার ‘আব্দার’-কে সামনে রেখে প্রশ্নটা উঠে আসা অস্বাভাবিক নয়। শিক্ষাজগতের অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করেছেনকল করার প্রবণতা কি বাড়ছে?
ছাত্র ভর্তি, কলেজে নকল করতে দেওয়ার ‘অন্যায় আবদার’ কিংবা প্রায় নিত্য অধ্যক্ষ ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেকে অনেকেই সত্তরের দশকে শিক্ষা ব্যবস্থার ‘অরাজক’ দিনগুলোকে মনে করছেন। কলেজ শিক্ষকদের অনেককেই বলতেও শোনা গিয়েছে, “মনে না করার কি কোনও কারণ আছে!”
বাঙালঝি কলেজের ঘটনাটাই ধরা যাক: সেখানে শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের আবদার ছিল নকলে বাধা দেওয়া তলবে না। অধ্যক্ষ কৃষ্ণগোপাল রায় বাধা দেওয়ায় তাঁকে ঘেরাও করে রাখাই নয়, শুনতে হয়েছিল অকথ্য গালমন্দ। এমনকী পরের দিন কলেজে এলে তাঁর ঘরের সামনে অনর্গল মোটরবাইকের হর্ন বাজিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল টিএমসিপি-র ‘বিরুদ্ধাচারণ’ করলে এমনই ‘শাস্তি’ বরাদ্দ। অপমানিত কৃষ্ণগোপালবাবু সে রাতেই পরিচালন সমিতির সভাপতির কাছে পদত্যাগ পত্র লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। নাছোড় শাসকদলের কর্মী সমর্থকেরা তাতেও পিছু ছাড়েননি তাঁর। পরের দিন তাঁকে রীতিমতো ‘চাপ’ দিয়ে দলের জেলা নেতার বাড়ি নিয়ে গিয়ে শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে কতা বলিয়ে পদত্যাগ প্রত্যাহারের সম্মতি আদায় করে নিয়েছিলেন বলে বিরোধীদের অভিযোগ।
এই ঘটনায় জেলার বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। কৃষ্ণনগরের দ্বিজেন্দ্রনাথ কলেজের অধ্যক্ষ সাহাজাহান আলি বলেন, ‘‘দিন দিন পরীক্ষার পরিবেশ বজায় রাখাই কঠিন হয়ে পড়ছে। পরীক্ষার্থীরা রীতিমত দাবি করতে শুরু করেছে যে তাদের নকল করতে দিতে হবে। এই সাহস তারা কোথা থেকে পাচ্ছে সেটা খুঁজে বের করার দরকার হয়ে পড়ছে। ” তাঁর কথায় স্পষ্ট, ছাত্রদের পিছনে রয়েছে প্রভাবশালী তথা ক্ষমতাশালীদের হাত। এক শিক্ষাকর্তার কথায়, “আর এই রাজ্যে এখন ক্ষমতা কাদের হাতে তা-ও জলের মতো স্পষ্ট।” শিক্ষকদের অনেকেই অবশ্য বাঙালঝি কলেজের অধ্যক্ষের ‘সাহসে’ অবশ্য ‘আশা’র আলো দেখছেন।
একই প্রতিক্রিয়া মাজদিয়ার সুধিরঞ্জন লাহিড়ী কলেজের অধ্যক্ষ সরোজেন্দ্র নাথ করের। তিনি বলেন, ‘‘পরীক্ষার্থীদের দাপট যেন একটু বেশিই। নকল করার দাবিটাও যেন বেশি থাে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত হোম সেন্টার তুলে দেওয়া।’’ তিনি বলেন,‘‘অনেক সময় হেনস্থা হওয়ার ভয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা যতটা কড়া হওয়ার কথা ততটা কড়া হতে পারছি না। কেন? তাহলে কি পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে?” প্রশ্নটা তুলেছেন তিনি। শান্তিপুর কলেজের টিচার ইন চার্জ চয়ন ভট্টাচার্য যেমন বলেন, ‘‘নকল করা আটকান ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। প্রশাসন,অভিভাবক ও সর্বোপরি ছাত্র সংসদগুলি এগিয়ে না এলে নকল করা বন্ধ করা কঠিন হয়ে দাঁনাবে।” তবে কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ জয়শ্রী রায় চৌধুরী অবশ্য বলেন, ‘‘আমাদের কলেজে নকল করতে দেওয়ার দাবি তেমন দেখি না। তবে প্রবনতা যে বেড়েছে তা বলা বাহুল্য।” মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অসীম মন্ডল বলেন, ‘‘টোকাটুকির এই সমস্যা থেকে আমাদের কলেজও মুক্ত নয়। কদিন আগেই অন্য এক কলেজের প্রথম বর্ষের জনা কয়েক পরীক্ষার্থী হলের মধ্য টোকাটুকি করতে বেপরোয়া ও মারমুখী হয়ে উঠেছিল। নজরদার শিক্ষকের উপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করে তারা।” এমন প্রবণতা কিন্তু ক-বছর আগেও ছিল না বলে জানিয়েছেন জেলার বিভিন্ন কলেজের বহু শিক্ষকই।
বহরমপুরে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সমরেশ মণ্ডল বলেন, “ভাবনা-চিন্তা করেই যে কোনও অধ্যক্ষ পদ থেকে অব্যাহতি চাওয়া উচিত। কারণ আমরা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নয়। অধ্যক্ষের চেয়ারে বসার আগেই আমরা জানি, আমাদের উপরে রাজনৈতিক সব ধরণের চাপ থাকবেই। তার মধ্যেই নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে হবে কলেজের স্বার্থে। কখনও কোনও ছাত্র সংগঠনকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। তবে টোকাটুকি বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক। এটা কোনও শর্ত হতে পারে না। ছাত্র সংগঠন কলেজে থাকলেই ওই ধরণের ঘটনা ঘটবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy