Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

নদী ও দ্বীপকে ঘিরে এখনও স্বপ্ন দেখে রঘুনাথগঞ্জ

শহরে ২০০০ সালের বন্যার পর ১৪ বছর কেটে গিয়েছে। রঘুনাথগঞ্জের গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া কালমন ও খড়খড়ি নদী দু’টি নিয়ে তবু টনক নড়েনি সেচ দফতর বা জঙ্গিপুর পুরসভার। চার দশক আগেও এই নদী দিয়েই বয়ে গিয়েছে গুজিরপুর দিয়ে ধেয়ে আসা ভাগীরথীর জলপ্রবাহ। আর আজ সেই নদীর জলস্রোতের পথে বাধা হয়ে গড়ে উঠেছে হাজারো ইমারত। কোথাও ইটের ভাটা, কোথাও বা সড়ক পথ।

রঘুনাথগঞ্জে অবরুদ্ধ খড়খড়ি নদী। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।

রঘুনাথগঞ্জে অবরুদ্ধ খড়খড়ি নদী। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।

বিমান হাজরা
রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৪ ০১:২১
Share: Save:

শহরে ২০০০ সালের বন্যার পর ১৪ বছর কেটে গিয়েছে। রঘুনাথগঞ্জের গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া কালমন ও খড়খড়ি নদী দু’টি নিয়ে তবু টনক নড়েনি সেচ দফতর বা জঙ্গিপুর পুরসভার। চার দশক আগেও এই নদী দিয়েই বয়ে গিয়েছে গুজিরপুর দিয়ে ধেয়ে আসা ভাগীরথীর জলপ্রবাহ। আর আজ সেই নদীর জলস্রোতের পথে বাধা হয়ে গড়ে উঠেছে হাজারো ইমারত। কোথাও ইটের ভাটা, কোথাও বা সড়ক পথ। কোথাও বা অবরোধ ইট ও বাঁশের বেড়ার। শহর ছেড়েই নদীর গতিমুখ থমকে দিয়েছে গড়ে ওঠা চাষের জমিতে। ফলে শহরের সঞ্জীবনী খরস্রোতা কালমন ও খড়খড়ি আজ নেহাতই অবরুদ্ধ জলাশয় বই কিছু নয়। অথচ এই দুই নদীকে ঘিরেই বারবার আশা ও স্বপ্ন দেখেছেন শহরের মানুষ।

অতীতে একাধিক সময়ে নানা পরিকল্পনার কথা শুনিয়েছে সেচ দফতর এবং জঙ্গিপুর পুরসভা। কিন্তু নদীর গতিমুখকে অবাধ করার কোনও উদ্যোগ নেয়নি কেউই। অতীতের ভৌগলিক পথের পরিচয়ে উত্তরে ভাগীরথী নদীর জলস্রোত এসে মিশেছে রঘুনাথগঞ্জ শহরের প্রবেশপথ গুজিরপুরে কালমনের স্রোতে। শহরের পশ্চিম গা ঘেঁষে মাইল দেড়েক গিয়েই কালমন মিশেছে খড়খড়িতে। শহর ছাড়িয়ে খড়খড়ির স্রোত গিয়ে পড়েছে বাঁকি, মোগলমারি নালা পেরিয়ে গণকরের বিল ধেয়ে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরে সাগরদিঘির কিসমত গাদির কাছে ফের ভাগীরথীতেই। রঘুনাথগঞ্জ শহরের বাসিন্দা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক ক্ষেমানন্দ মণ্ডলের কথায়, রঘুনাথগঞ্জ শহরের জল নিকাশির মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে এই দুই নদীর। শহরের গা ধুয়ে বয়ে যাওয়া জলই শুধু নয়, উত্তরে বর্ষায় বাঁশলৈ ও পাগলা নদীর দাপটে যখনই ভাগীরথীর জলস্ফীতি ঘটেছে, গুজিরপুর দিয়ে সেই জল আছড়ে পড়েছে কালমনে। খড়খড়ি, বাঁকির পথ ধরে উপচে আসা জল গিয়ে মিশেছে সাগরদিঘির গাদিতে ফের ভাগীরথীর বুকেই। নদীর সেই সরল যাত্রাপথ এখন আগলে দাঁড়িয়েছে বেলাগাম নির্মাণ। ফলে বিপন্ন নিকাশি। মহকুমা শহর রঘুনাথগঞ্জকে ঘিরে রেখেছে পুর্বে ভাগীরথী, পশ্চিমে কালমন ও খড়খড়ি। দু’পাশে দুই নদীর এই সহাবস্থানের ফলে ভরা বর্ষাতেও বরাবরই শহরের জনপদ ছিল যথেষ্ট নিরাপদ। একসময় নদীটি চওড়ায় ছিল প্রায় দেড়শো মিটারেরও বেশি। তাই ২০০০ সালের বন্যা রঘুনাথগঞ্জ শহরকে ব্যতিব্যস্ত করলেও সে ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি। কিন্তু যত দিন গিয়েছে, নদীর দু’পাড়ে বেড়েছে কলোনির সংখ্যা। কলোনির বসতি যত বেড়েছে নদীর চওড়া বুক ততই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এখন দাঁড়িয়েছে কোথাও ৪০ মিটার, কোথাও বা আরও কম। জঙ্গিপুর মহকুমা আদালত চত্বর পর্যন্ত কালমনের বুক চিরেই গড়ে উঠেছে দু’টি ইটভাটা, চালকল। যে যেমন পেরেছে নদীকে আটকে দিয়ে গড়ে তুলেছে অজস্র পুকুর, ইমারত।

বেসরকারি সংস্থার এক ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, সাংসদ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে ২০০৮ সালে এই দুই নদীকে ঘিরে ৩৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছিল। তাতে এই দুই নদীকে দুভাবে ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রথমত, রঘুনাথগঞ্জ শহরের বাড়তি জলের নিকাশি, দ্বিতীয়ত, নদীর দু’পাড় সুরক্ষিত করে বাঁধিয়ে সেখানে নিয়মিত ভাবে মাছ চাষের ব্যবস্থা করা। শুধুমাত্র এই নদীর শহর ঘেঁষে থাকা ৩ কিলোমিটারের জলাশয় থেকে যে পরিমাণ মাছের জোগান মিলবে, তাতে রঘুনাথগঞ্জের মতো দু’তিনটি শহরের মাছের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। যতদূর জানি, এই প্রকল্প জমাও দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় সেচ মন্ত্রকের কাছে। কিন্তু তারপর আর সে প্রকল্প নিয়ে এগোয়নি কেউই।

সেচ দফতরের সহকারী বাস্তুকার হিসেবে রঘুনাথগঞ্জে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন মানসরঞ্জন গণ। মানসবাবুও বার বার চেয়েছিলেন এই দুই নদীকে ঘিরে রাজ্য সরকার উদ্যোগী হলে এলাকায় বাণিজ্যের উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হবে। এর জন্য তাঁর উদ্যোগেই রাজ্য সেচ দফতরও তৈরি করে প্রায় ৩৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প। তাতে বলা হয়, শহরের প্রবেশ পথ গুজিরপুরের কাছে যেখানে কালমন ও ভাগীরথীর প্রবাহ গিয়ে একসাথে মিশেছে, সেখানে একটি স্লুইস গেট বসিয়ে দু’টি নদীর জলপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ ও কালমন এবং খড়খড়িকে খনন করে তাদের জলধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা হবে। মানসবাবু বলেন, “ঝাড়খন্ড থেকে বাঁশলৈ ও পাগলার ধেয়ে আসা জল প্রতিবছরই রাজ্য সরকারের কাছে একটা মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই জল ভাগীরথীতে এসে পড়লে তা এতটাই স্ফীত হয়ে ওঠে যে তা ‘ব্যাক ফ্লো’ হয়ে গিয়ে পড়ে কালমনে। গুজিরপুরে লকগেট থাকলে সেটা ঠেকানো যাবে। কালমন ও খড়খড়িতে সারা বছর জল থাকলে তাতে একদিকে যেমন ব্যাপক ভাবে মৎস্য চাষের সুযোগ বাড়বে, তেমনই সে জল লাগানো যাবে সেচের কাজেও।”

সেই প্রকল্প রাজ্য সেচ দফতরে জমাও পড়ে। কিন্তু মানসবাবু রঘুনাথগঞ্জ ছেড়ে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যেতেই সে প্রকল্প গিয়ে পড়ে বিশ বাঁও জলে। মানসবাবু বলেন, “এই দুই নদীর মালিকানা নিয়ে এক জমিদার পরিবারের সঙ্গে আদালতে দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলছে রাজ্য সরকারের। সম্ভবত সেই কারণেই প্রকল্প নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি রাজ্য সরকার।” বসে থাকেনি জঙ্গিপুর পুরসভাও। জঙ্গিপুরের পুরপ্রধান মোজাহারুল ইসলাম বলেন, “বছর তিনেক আগে দিল্লি থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের এক প্রতিনিধি দল রঘুনাথগঞ্জে এসে সমীক্ষা করে গিয়েছিলেন কালমন ও খড়খড়িকে নিয়ে। তাঁদের কাছে পুরসভার তরফে ১৬০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প জমা দেওয়াও হয়। তারপর আর কোনও সাড়া মেলেনি। অথচ সে প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শহরের আর্থসামাজিক চিত্রটাই অনেকটাই বদলে যেত। শুধু তাই নয়, বহু মানুষের রুজির সংস্থান হত।” শুধু এই দুই নদীই নয়, রঘুনাথগঞ্জের উন্নয়নে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিতে পারে সবুজ দ্বীপ। ৬৮ একরের নেহাতই একটি চর জমি গজিয়ে উঠেছিল শহর লাগোয়া ভাগীরথীর বুকে। বছর ১৮ আগে পুরসভা ও জেলা পরিষদ যৌথ উদ্যোগে ৩৮ লক্ষ টাকা দিয়ে চরকে সাজিয়ে তোলে। ‘দ্বীপে’ কয়েক হাজার বনসৃজন করা হয়। ২০০২ সালে কৃষি মেলার আয়োজন করে নেতাজী সুভাষ দ্বীপ নামকরণ করে সেখানে বসানো হয় শিশুদের নানাধরনের বিনোদন সামগ্রী। চালু হয় টয়ট্রেন, বোটিং। চালু হয় সর্প উদ্যানও। মুর্শিদাবাদ জেলার পর্যটন মানচিত্রে অচিরেই জায়গা করে নেয় ভাগীরথীর তীর বরাবর রঘুনাথগঞ্জের এই দ্বীপটি। পর্যটনে জোর দিতে দ্বীপে নিষিদ্ধ করা হয় পিকনিকের আয়োজনও। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সে চেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়ে দু’বছরের মধ্যেই। তারপর দ্বীপের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে পর্যটনের নাম মুছে দিয়ে পুরসভাই সবুজ দ্বীপকে পিকনিক স্পট হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। এক সময় দ্বীপের ভার নেয় একটি বেসরকারি সংস্থাও। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। এখন দ্বীপটি টিকে আছে কোনোরকমে পুরসভার নিয়ন্ত্রণেই। পুরপ্রধান বলেন, “দ্বীপটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে চালাতে প্রতি মাসে ৫ থেকে ৬ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। দ্বীপ থেকে বছরে যা আয় হয়, তাতে সে খরচের সঙ্কুলান করা সম্ভব নয়। রাজ্য সরকার এ বছর দ্বীপে পর্যটকদের জন্য ৪টি কটেজ তৈরি করে দিলেও পর্যটকরা না এলে সেখানে থাকবেন কারা।” তিনি জানান, তাই প্রথমে দ্বীপটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সাজিয়ে তুলতে গেলে কয়েক কোটি টাকার দরকার। পুরসভা কোথায় পাবে সে টাকা। একসময় কাউন্সিলার হিসেবে দ্বীপটির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব সামলেছেন রঘুনাথগঞ্জের তৃণমুল সভাপতি গৌতম রুদ্র। বর্তমানে তাঁর স্ত্রী পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলার। গৌতমবাবুর আক্ষেপ, ‘‘লাভ লোকসানের অঙ্ক দিয়ে সব কিছুর হিসেব করলে কি চলে। রাজ্যে যত পর্যটন কেন্দ্র আছে সেগুলি কি সব লাভের মুখ দেখে? রঘুনাথগঞ্জ একটা মহকুমা শহর। এখানে বিনোদনের মতো পর্যটন কেন্দ্র কোথাও নেই। জেলাতেও নেই। তাই সবুজ দ্বীপকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

people's dream biman hazra raghunathganj
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE