Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নববর্ষে মনে পড়ে ওপারের কথা

হোক না কেনা দুধ। ছোট পাত্রে জ্বাল দিয়ে কিছুটা দুধ মাটিতে ফেলে দিয়ে ‘দুধ-ওথলানো’র প্রথাটা এখনও চালু রেখেছেন করিমপুরের আনন্দপল্লির নব্বই ছুঁই-ছুঁই মেনকাদেবী। আর রানিনগরের অনিমেষ মণ্ডল ইলিশ মাছের আয়োজন করতে না পরলেও বছর শুরুর প্রথম দিনটা পান্তা ভাত খাবেনই খাবেন। ভিটে ছেড়ে এলেও ওপার বাংলার মধুর স্মৃতি সযত্নে আঁকড়ে রেখেছেন অধুনা এপারের বাসিন্দারা। বছর শুরুর দিনটা ওপারের ‘প্রথা’ মেনে সেই স্মৃতির রোমন্থন করেন তাঁরা।

প্রথা মেনে। নিজস্ব চিত্র।

প্রথা মেনে। নিজস্ব চিত্র।

গৌরব বিশ্বাস ও সুজাউদ্দিন
কলকাতা ও ডোমকল শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৪ ০১:৫২
Share: Save:

হোক না কেনা দুধ। ছোট পাত্রে জ্বাল দিয়ে কিছুটা দুধ মাটিতে ফেলে দিয়ে ‘দুধ-ওথলানো’র প্রথাটা এখনও চালু রেখেছেন করিমপুরের আনন্দপল্লির নব্বই ছুঁই-ছুঁই মেনকাদেবী। আর রানিনগরের অনিমেষ মণ্ডল ইলিশ মাছের আয়োজন করতে না পরলেও বছর শুরুর প্রথম দিনটা পান্তা ভাত খাবেনই খাবেন। ভিটে ছেড়ে এলেও ওপার বাংলার মধুর স্মৃতি সযত্নে আঁকড়ে রেখেছেন অধুনা এপারের বাসিন্দারা। বছর শুরুর দিনটা ওপারের ‘প্রথা’ মেনে সেই স্মৃতির রোমন্থন করেন তাঁরা।

পেশায় বই ব্যবসায়ী করিমপুরের পিন্টু ঘোষের যেমন ছোটবেলাটা কেটেছে বাংলাদেশে। এপার বাংলায় এসেও নববর্ষে ঠিক মনে পড়ে রাজশাহীর কথা। তাঁর কথায়, “পদ্মাপারের সেই মেলা, চিকচিক বালি, গোটা মহল্লা জুড়ে হইহই, সে এক অন্যরকম অনুভূতি।” ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বিছানা থেকে তুলে দিতেন বাড়ির বড়রা। রাজশাহীর সাহেববাজার তখন রীতিমতো উৎসবের মেজাজে। কুমারপাড়ার রাস্তা দিয়ে হাজার হাজার মানুষ হেঁটে চলেছেন পদ্মায় স্নান করতে। সেই কাকভোরেই পদ্মাপাড়ে বসে গিয়েছে নানা রকমের অস্থায়ী দোকান। দল বেঁধে নদীতে স্নান করে বাড়ি ফিরে নতুন জামাকাপড়। সকালের জলখাবারে গরম গরম ফুলকো লুচি আর আলুর দম। দুপুরে পোলাও আর খাসির মাংস। নানা রকমের মিষ্টি তো আছেই। বাড়ির মহিলারা অবশ্য পুজো-পাঠ সেরে তারপরে উপোস ভাঙতেন। পিন্টুবাবু বলেন, “এপার বাংলায় চলে এলেও রেওয়াজটা কিন্তু থেকেই গিয়েছে। নববর্ষের দিন পদ্মায় না হলেও সকালে বাড়িতেই স্নান সেরে নিই। সেই ছোটবেলার মতো মা এদিনও পুজো করেন। সকালের পাতে লুচি, আলুর দম থাকলেও দুপুরে সাদা ভাত দিয়ে খাসির মাংস।”

আনন্দপল্লির মেনকা সাহার স্মৃতিতেও নববর্ষের স্মৃতি অমলিন। মেনকাদেবী জানান, তাঁর বাবার বাড়ি ছিল বাংলাদেশের অলোকডাঙায় আর শ্বশুরবাড়ি মনোহরদিয়াতে। তখন বাংলা নববর্ষ পালন করা হত বেশ ধুমধাম করে। বাড়িতে গোয়ালভর্তি গরু। বাংলা বছরের প্রথম দিনে ভগবতী পুজো হত। গোয়ালঘরে উনান তৈরি করে মাটির হাঁড়িতে দুধ রেখে ফোটানো হত, যতক্ষণ পর্যন্ত উথলে মাটিতে না পড়ে। এর নাম দুধ-উথলানো। মেনকাদেবী বলেন, “সকাল থেকে এই সব পর্ব মিটিয়ে উপোসভঙ্গ করতাম। বাড়িতে পুরোহিত আসতেন পুজো করতে। তারপর সারাদিন ধরে খাওয়া-দাওয়ার এলাহি আয়োজন তো ছিলই।” সাহা পরিবারে এখন গোয়াল কিংবা গরু কোনওটাই নেই। তবে ছেলে, বউমা, নাতি, নাতবৌ এবং তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে মেনকাদেবীর এখন জমজমাট সংসার। তাঁরই তত্ত্বাবধানে পুরনো সেই ঐতিহ্য বজায় রেখে আজও নববর্ষের দিনটি অন্যরকম ভাবেই পালন করা হয়। মেনকাদেবী বলেন, “এখন আর সেসব কিছুই নেই। তবে ঘরের মধ্যে ছোট্ট পাত্রে দুধ জ্বাল দিয়ে এখনও কিছুটা দুধ মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়।”

রানিনগরের অনিমেষ মণ্ডল বলেন, “ওই দিন বাড়িতে যেই আসুক না কেন মিষ্টিমুখ না করিয়ে তাঁকে যেতে দেওয়া হত না। নববর্ষের দিনে ইলিশ মাছ ভাজা ও পান্তাভাত ছিল এক বিশেষ মেনু।” দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে গেলেও ওপার বাংলার নববর্ষের স্মৃতি আজও উজ্জ্বল ডোমকলের প্রমীলা বিশ্বাসের। বছর সত্তরের বৃদ্ধা জানান, বাড়ি ছিল বাংলাদেশের ঝিনাইদহে। প্রমীলাদেবী বলেন, “বাড়ির সকলেই ছিলেন খাদ্যরসিক। ফলে আয়োজনও হত তেমনই। খাওয়া-দাওয়া, হইচই করেই শুরু হত বছরের প্রথম দিন।”

আর এখন?

প্রমীলাদেবীর স্বামী মারা গিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে। একমাত্র মেয়েরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ডোমকলের বাড়িতে একাই থাকেন প্রমীলাদেবী। নববর্ষ মানে তাঁর কাছে এখন শুধুই স্মৃতি। নববর্ষের সেই সব দিনের কথা ভাবতে-ভাবতে কেটে যায় আরও একটা পয়লা বৈশাখ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

gourav biswas sujauddin domkal bengali new year
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE