Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ফেসবুকের সূত্র ধরে ছাত্র খুনে ধৃত তিন

ফেসবুকের সূত্র ধরে কৃষ্ণনগরে আট মাস আগে এক ছাত্র খুনের ঘটনায় তিন যুবককে গ্রেফতার করল পুলিশ। ধৃত শুভ দেবনাথ দিগনগরের বাসিন্দা, সূযর্র্ চট্টোপাধ্যায় কৃষ্ণনগরের মল্লিকপাড়া ও পেশায় গাড়ির চালক বিশ্বজিত্‌ দাস নগেন্দ্রনগরের বাসিন্দা। মঙ্গলবার দুপুরে ওই তিন জনকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়।

অতনুর খুনের ঘটনায় ধৃত তিন অভিযুক্ত। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

অতনুর খুনের ঘটনায় ধৃত তিন অভিযুক্ত। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ০০:১৭
Share: Save:

ফেসবুকের সূত্র ধরে কৃষ্ণনগরে আট মাস আগে এক ছাত্র খুনের ঘটনায় তিন যুবককে গ্রেফতার করল পুলিশ। ধৃত শুভ দেবনাথ দিগনগরের বাসিন্দা, সূযর্র্ চট্টোপাধ্যায় কৃষ্ণনগরের মল্লিকপাড়া ও পেশায় গাড়ির চালক বিশ্বজিত্‌ দাস নগেন্দ্রনগরের বাসিন্দা। মঙ্গলবার দুপুরে ওই তিন জনকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়।

এ বছরের ৩ মার্চ কৃষ্ণনগরের কলিজিয়েট স্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্র অতনু মণ্ডল (১৭) খুন হয়। অতনুর বাবা অনিলবাবু আয়কর দফতরের কর্মী। মা জেলা সদর হাসপাতালের নার্স। ঘটনার দিন রাতে এক বন্ধুর জন্মদিনে যোগ দিতে যাচ্ছে বলে বাড়িতে ফোন করে জানায় ওই ছাত্র। তারপরে সে আর বাড়ি ফেরেনি। ওই দিন রাত পৌনে দু’টো নাগাদ অতনুর ফোন থেকে অনিলবাবুর কাছে একটা ফোন আসে। এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি ইংরেজিতে জানায় যে, ছেলেকে ফেরত পেতে গেলে বাড়ির বাইরে রাখা চিঠির নির্দেশ মতো কাজ করতে হবে। চিঠি পড়ে অনিলবাবু জানতে পারেন অতনুকে অপহরণ করা হয়েছে। ১২ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দিলে তবে ছেলেকে তিনি ফেরত পাবেন। ওই চিঠিতে পুলিশকে না জানানোর জন্য হুমকিও দেওয়া হয়। কিন্তু পরের দিন অর্থাত্‌ ৪ মার্চ কৃষ্ণনগরের কাছে চর শম্ভুনগরের ঘাটে অতনুর দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ঘটনার পরে অনিলবাবু অতনুর এক বান্ধবী, গৃহশিক্ষক ও শুভ দেবনাথের নামে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ অতনুর ওই বান্ধবী ও ওই গৃহশিক্ষককে গ্রেফতার করে। পরে তাঁরা জামিনে ছাড়া পান। কিন্তু অধরা থেকে যায় শুভ দেবনাথ।

এ দিকে, তদন্তে পুলিশ তেমন উত্‌সাহ দেখাচ্ছে না এই মর্মে অভিযোগ তুলে সিআইডি তদন্তের দাবি জানিয়ে চলতি বছরের জুন মাসে হাইকোর্টের দারস্থ হন অনিলবাবু। বিচারপতি কোতোয়ালি থানার পুলিশের কাছে কৈফিয়ত চান। কিন্তু পুলিশের দেওয়া রিপোর্টে সন্তুষ্ট না হয়ে বিচারপতি পুলিশ সুপারকেই তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দিতে বলেন। এই নির্দেশ পাওয়ার পরেই গত ১৫ সেপ্টেম্বর জেলা পুলিশের বেশ কয়েকজন পদস্থ পুলিশকে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করে তদন্ত শুরু হয়।

তদন্তে নেমে পুলিশ প্রথমে নিহত ছাত্র অতনু মণ্ডলের ফেসবুকের প্রোফাইল থেকে তার বেশ কিছু ‘কমন’ বন্ধুকে চিহ্নিত করে। তারপরে তাদের উপরে কড়া নজরদারি চালানো হয়। তখনই পুলিশ জানতে পারে যে অতনুর বন্ধু শুভ দেবনাথ ঘটনার পর থেকেই এলাকা ছাড়া। এ ছাড়াও ওই ‘কমন ফ্রেন্ডস’দের কয়েকজনকে একাধিকবার থানায় ডেকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের মধ্যে ধৃত সূর্য চট্টোপাধ্যায়ও ছিল। কিন্তু প্রতি বারই সে পুলিশকে নানা ভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। এরই মধ্যে পুলিশ খবর পায় শুভ জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষে বাড়ি ফিরছে। সেই মতো পুলিশও অপেক্ষায় ছিল তার বাড়ি ফেরার। শনিবার সে বাড়ি ফেরে। তারপর মঙ্গলবার দুপুরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ওই তদন্তকারী দলের এক আধিকারিক জানান, তদন্তে নেমে প্রথমে তাঁরা তেমন কোন সূত্রই খঁুজে পাচ্ছিলেন না। ঠাণ্ডা মাথায় সব ধরনের প্রমাণ অভিযুক্তেরা নষ্ট করে দিয়েছিল। তখন ফেসবুক ঘাঁটতে শুরু করে তদন্তকারী ওই দল। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আধিকারিকদের দিয়ে নিহত ছাত্রের ফেসবুক প্রোফাইল ‘স্টাডি’ করা হয়। তাতে প্রাথমিক ভাবে বন্ধু তালিকা থেকে কয়েক জনকে চিহ্নিত করা হয়। সেই সূত্র ধরে এগিয়েই এই খুনের কিনারা করা গেল।”

পুলিশের জেরায় ধৃতেরা জানায় যে, অতনুর জীবনযাত্রা দেখে তারা মনে করেছিল যে অতনুকে অপহরণ করলে মোটা টাকা মিলবে। সেই মতো তারা অপহরণের ছক কষে। পরিকল্পনা মতো ঘটনার দিন অতনুকে মদ খাওয়ার নাম করে কৃষ্ণনগরের পাশে রোড স্টেশন সংলগ্ন একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তারা মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বেহুঁশ করে দেয়। তারপরে অতনুকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। সেখান থেকে অতনুর দেহ গাড়িতে চাপিয়ে চর শম্ভুনগর ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। মৃত্যু নিশ্চিত করতে পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে একটা ভারি পাথরের সঙ্গে দেহ বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, প্রথম দিকে জেরার সময় শুভ ঠাণ্ডা মাথায় গোটা ঘটনাটি অস্বীকার করে। কিন্তু পরে বেশ কয়েক দফায় পুলিশের জেরার সামনে সে ভেঙে পড়ে। সেই সঙ্গে সূর্য ও গাড়ির চালক বিশ্বজিতের নামও বলে। জেরায় ধৃত তিন জনেই তাদের দোষ কবুল করেছে বলে পুলিশ জানায়। জেলার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, “ধৃতেরা খুব ঠাণ্ডা মাথায় অপহরণের পরিকল্পনা করেছিল। তারা এই ঘটনায় সব রকম প্রমাণও লোপাট করে ফেলে। যদিও শেষ পর্যন্ত ফেসবুকের সূত্র ধরে তিন জনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এই ঘটনায় আরও একজন জড়িত বলে আমরা জানতে পেরেছি। তার খোঁজেও তল্লাশি শুরু হয়েছে।”

ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পেরেছে, ঘটনার পাঁচ দিন আগে সূর্য তার কম্পিউটারে ইংরেজিতে অপহরণের ওই চিঠিটি লিখেছিল। প্রমাণ লোপাট করতে সেই কম্পিউটারের হার্ডডিক্স সে নষ্ট করে ফেলে। চিঠিটা ‘প্রিন্ট’ করার জন্য যে ‘পেনড্রাইভ’ ব্যবহার করা হয়েছিল সেটা ও অপহরণের কাজে ব্যবহৃত মোবাইলটি সে নষ্ট করে দেয়। এমনকী যে ‘সিম’ ব্যবহার করেছিল সেটাও তারা পরিকল্পিত ভাবে ভুয়ো নথি দিয়ে তুলেছিল। যাতে পুলিশ মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে তাদের কাছে পৌঁছতে না পারে। জেলা পুলিশের ওই আধিকারিক বলেন, “ধৃতেরা এই প্রথম অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। সেই অর্থে তারা একেবারেই আনকোরা। তবুও তারা এই বয়সে যে ভাবে নিখুঁত পরিকল্পনা করেছিল তাতে আমরাও অবাক হয়ে গিয়েছি।” পরিকল্পনা মতোই সব কিছু ঠিকঠাক এগোচ্ছিল। কিন্তু পরের দিনই অতনুর দেহ ভেসে ওঠায় গোটা পরিকল্পনাটাই মাঠে মারা যায়। না হলে তারা টাকাও আদায় করেই ছাড়ত বলে মনে করছে পুলিশ। অর্ণববাবু বলেন, “তদন্তে আমরা জানতে পেরেছি যে খুন করার পরেই ধৃতরা মুক্তিপণের জন্য অনিলবাবুকে ফোন করেছিল।”

কিন্তু মুক্তিপণ আদায় যদি মূল উদ্দেশ্য হয় তাহলে প্রথমেই অতনুকে খুন করা হল কেন? পুলিশ সুপার বলেন, “আসলে ওরা প্রথম থেকেই ছাত্রটিকে খুনের পরিকল্পনা করেছিল। কারণ টাকা পাওয়ার পরে ছেড়ে দিলে ছাত্রটি বাড়ি ফিরে ওদের নাম বলে দিত। কারণ অতনু তাদের সবাইকেই চিনত।”

পুলিশ জানিয়েছে, শুভর পরিবার অতনুদের বাড়ির পাশেই থাকত। ঘটনার কয়েক মাস আগে তারা বাড়ি বিক্রি করে দিগনগরে চলে যায়। শুভ ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করলেও অতনুর সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল ছোটবেলা থেকেই। ঘটনার পরে শুভ বেঙ্গালুরুতে পালিয়ে গিয়ে একটা হোটেলে কাজ করে। তবে এই ঘটনার মূল মাথা ছিল সূযর্র্। তার বাবা একজন সরকারী চাকুরিজীবী। এলাকায় সে যথেষ্ট মেধাবী ছাত্র বলেই পরিচিত।

ছেলের খুনিরা ধরা পড়ায় খুশি অনিলবাবু। এ দিন তিনি বলেন, “শেষ পর্যন্ত ছেলের খুনিরা ধরা পড়েছে। আমি চাই তারা যেন কঠিন সাজা পায়। আমি পুলিশের বিরুদ্ধে যে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলেছিলাম, এই ঘটনা কিন্তু আমার অভিযোগকেই প্রমাণ করল।” তাঁর দাবি, তিনি পুলিশকে এর আগে সূর্য ও শুভর নাম জানিয়েছিলেন। পুলিশ তখন কোনও গুরুত্ব দেয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE