Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বাজার নেই, কার্পেট পড়ে গুদামে

তিল তিল শ্রম আর তিল তিল সাধ। তারই উপর ভিত বানিয়ে ৩৪ লক্ষ টাকার সরকারি সাহায্যে নবাবিয়ানার কার্পেট কারখানা গড়ে উঠেছিল মুর্শিদাবাদের ডোমকলে। সেখানে পাটের তৈরি কার্পেট বুনে দেশে-বিদেশে পাঠানোর স্বপ্ন বুনেছিল ‘দেশ অর্থনৈতিক সঙ্ঘে’র ২৭২ জন মহিলা। কিন্তু উৎপাদিত দ্রব্য বাজারজাত করতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়েছে সেই উদ্যোগ। থরে-থরে আধুনিক কার্পেট পড়ে নষ্ট হচ্ছে গুদামে। অথচ একটু রঙের প্রলেপ আর ফিনিশিং টাচ পেলেই এক-একটা কার্পেট কয়েক হাজার টাকা দামে বিক্রি হতে পারত।

সুজাউদ্দিন
ডোমকল শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৪ ০০:২০
Share: Save:

তিল তিল শ্রম আর তিল তিল সাধ। তারই উপর ভিত বানিয়ে ৩৪ লক্ষ টাকার সরকারি সাহায্যে নবাবিয়ানার কার্পেট কারখানা গড়ে উঠেছিল মুর্শিদাবাদের ডোমকলে। সেখানে পাটের তৈরি কার্পেট বুনে দেশে-বিদেশে পাঠানোর স্বপ্ন বুনেছিল ‘দেশ অর্থনৈতিক সঙ্ঘে’র ২৭২ জন মহিলা। কিন্তু উৎপাদিত দ্রব্য বাজারজাত করতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়েছে সেই উদ্যোগ। থরে-থরে আধুনিক কার্পেট পড়ে নষ্ট হচ্ছে গুদামে। অথচ একটু রঙের প্রলেপ আর ফিনিশিং টাচ পেলেই এক-একটা কার্পেট কয়েক হাজার টাকা দামে বিক্রি হতে পারত। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের অভিযোগ, প্রশাসন থেকে কারখানা তৈরির সময় আর্থিক সাহায্য মেলার ব্যাপারে যতট সহযোগিতা পাওয়া গিয়েছিল, পরে আর তা মেলেনি।

ডোমকল ব্লকের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি দেখভালের দায়িত্বে থাকা (ডব্লিউডিও) কৃষ্ণা সরকার বলেন, ‘‘আমি এখানে কাজে যোগ দেওয়ার পর বিষয়টি নজরে এসেছে। মহিলাদের অবস্থাটা সত্যিই কষ্টকর। অনেক পরিশ্রম করেও তাঁদের হাতে তৈরি কার্পেট বাজারজাত করতে পারছে না। আমি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব। তাছাড়াও ওই সঙ্ঘকে জিতপুর গ্রামীণ হাটে একটি স্টলও দেওয়া হবে।’’

শুরুটা কী ভাবে?

সঙ্ঘের সম্পাদিকা মর্জিনা বিবির কথায়, “তখন রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। আমাদের এলাকায় তখনও মহিলারা পর্দানসীন। আমরা কয়েক জন মহিলা কিছুটা বিদ্রোহী হয়ে বেরিয়ে পড়ি।” তবে সংসার ছেড়ে নয়। ভোর ৪টেয় উঠে গরু-গোয়াল সামলে রান্না করে বেরিয়ে পড়তাম। সারাদিন প্রশিক্ষণ নিয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা। এই গ্রাম ছাড়া নিয়ে প্রথমে অনেক কটূক্তি শুনতে হয়েছে। এমনকী প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় মহিলাদের বাইরে থাকা নিয়েও বিস্তর জলঘোলা হয়েছে গ্রামে। ডোমকল এলাকার মালতীপুর, হিতানপুর, জোড়গাছা গ্রামের মোড়লেরা গেল-গেল রব তুলে দেন এলাকায়। বিষয়টি নিয়ে অনেক পরিবারে অশান্তি ছড়ায়। কিন্তু তারপরেও টিপছাপ দেওয়া মহিলারা দাঁতে-দাঁত চেপে চালিয়ে যান। ৭২ দিন ধরে প্রশিক্ষণ চলে। মাস কয়েকের মধ্যেই সদ্য গঠিত সঙ্ঘে নাম লেখান ২৭৩ জন মহিলা। তাঁদের তিল তিল করে জমানো এক লক্ষ টাকায় যোগ হয় সরকারি ৩ লক্ষ টাকা। ডোমকল বাজার লাগোয়া এলাকায় কেনা হয় আড়াই বিঘা জমি। এরপর দফায় দফায় ৩৪ লক্ষ টাকা অনুদানে তৈরি হয় যাবতীয় পরিকাঠামো।

সকাল থেকে সন্ধেনতুন করে বাঁচার স্বপ্ন, স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন। তা করতে গিয়ে অমানবিক পরিশ্রম করছেন গ্রামের মহিলারা। সঙ্ঘের সভানেত্রী মানজুরা বিবির বাড়ি ডোমকলের গাড়াবাড়িয়ায়। তাঁর কথায়, ‘‘দিনাজপুর ও বেনারসে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর মেয়েদের তৈরি নিখুঁত নকশা করা এক-একটা কার্পেট দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। সে সব তৈরি করে আমরা অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম আমাদের কার্পেট দেশের নামী শহরে শপিং মলে বিক্রি হবে। ভাল দামও পাওয়া যাবে। কিন্তু সেটা আর মনে হয় বাস্তবে সম্ভব নয়। স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেল।’’

সরকার যখন জোর দিচ্ছে ক্ষুদ্রশিল্পে, ঠিক তখনই ডোমকলে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে গড়ে ওঠা সম্ভাবনাময় একটা শিল্প ধুঁকছে কেবল বাজার না পেয়ে। যদিও এক কার্পেট ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘ওই কার্পেটগুলি বাজারজাত করার আগে ফিনিশিং টাচ প্রয়োজন। তা না হলে বাজার পাওয়া কঠিন হবে।”

ডোমকলের মহকুমাশাসক পুষ্পেন্দু মিত্রের আশ্বাস, ‘‘বিষয়টি নিয়ে ওই সঙ্ঘের মহিলাদের সঙ্গে আমি কথা বলব। তাঁদের পণ্য যাতে বাজার পায়, তার চেষ্টা করা হবে। এত বড় একটা সম্ভাবনাময় শিল্প বাজারের অভাবে নষ্ট হলে ডোমকলের বড় ক্ষতি হবে।’’

জেলা জীবিকা উন্নয়ন আধিকারিক কৃষ্ণেন্দু সরকার বলেন, ‘‘এক জন কার্পেট ব্যাবসায়ীর পরিচালনায় ওই সংস্থাটি চলত। কিন্তু সংস্থার মেয়েরা চাইছে নিজেরাই তাদের তৈরি পণ্য বিক্রি করতে। এই নিয়ে একটি টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। ফলে ওদের উৎপাদিত পণ্য পড়ে আছে। ওই মহিলাদের তৈরি কার্পেট ফিনিশিংয়ের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। ওই কার্পেট যাতে বাজার পায় সেটিও দেখব আমরা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

carpet factory sujauddin domkal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE