শান্তি দাস।
সাধের ঢাকের কী হবে?
না, মৃত্যুর আগে এই নিয়ে বিশেষ ভাবতে হয়নি বর্ধমানের চুপি কাষ্ঠশালী গ্রামের ঢাকি আনন্দ দাসকে। স্ত্রীকে তিনি বলে গিয়েছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর সাধের ঢাক যেন তুলে দেওয়া হয় নবদ্বীপ তেঘড়িপাড়া সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটিকে। সোমবার আনন্দবাবুর স্ত্রী শান্তিদেবী সেই ঢাক তুলে দিলেন পুজো কমিটির হাতে। আনন্দবাবু আর বেঁচে নেই। কিন্তু গত আট দশকের মতো বোধন থেকে বিসর্জন পর্যন্ত তাঁর ঢাকের বোলেই মেতে উঠবে তেঘড়িপাড়া। প্রতি বছর।
সোমবার সাতসকালে নবদ্বীপের লালু মোদকের মিষ্টির দোকানে বসেছিলেন শান্তিদেবী। দোকানের মালিক অবশ্য তাঁকে চিনতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কি নেবেন দিদিমা?” মাথা নাড়তে নাড়তে নাড়তে শান্তিদেবী জবাব দিয়েছিলেন, “কিছু নেব না গো ছেলে। আজ আমি দেব। এতদিন তো তোমরা দিয়েছ। আজ আমার পালা।” ইতিমধ্যে মোড়ের মাথায় একে একে জড়ো হয়েছেন তেঘড়িপাড়া পুজো কমিটির লক্ষ্মী চট্টোপাধ্যায়, গোরা ভট্টাচার্য, অলোক চট্টোপাধ্যায়, সুজিত মণ্ডল, গোবিন্দ বাগ। তাঁরা এসে চিনতে পারেন শান্তিদেবীকে।
সেই ঢাক।
কিন্তু আনন্দবাবুর সাধের ঢাক নবদ্বীপের এই পুজো কমিটির হাতে তুলে দেওয়া হল কেন? পুজো কমিটির কর্তারা জানান, সেই ১৯৩০ সালে নবদ্বীপের দক্ষিণ অঞ্চলের প্রথম বারোয়ারি দুর্গা পুজো শুরু করেছিল তেঘড়িপাড়া। সে বছর চুপি কাষ্ঠশালী থেকে ঢাক বাজাতে এসেছিলেন আনন্দবাবুর বাবা কালীপদ দাস। আনন্দর বয়স তখন সাত বছর। বাবার সঙ্গে তিনি তখন কাঁসি বাজাতেন। তারপর বাবার ঢাক উঠে আসে ছেলের কাঁধে। সেই থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর তেঘড়িপাড়ার দুর্গা পুজোতেই ঢাক বাজিয়েছেন আনন্দ দাস। হাজার প্রলোভনেও দুর্গা পুজোর সময় তাঁকে তেঘড়িপাড়া থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারেননি কেউ। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে আনন্দবাবু মারা যান। সেবারের পুজোতেও শান্তিদেবী বয়ে এনেছিলেন স্বামীর ঢাক। শান্তিদেবী বলেন, “ছেলেরা এখন তাঁতের কাজ করে। বড় ছেলে ঢাক বাজালেও সে আলাদা থাকে। এসব নিয়ে লোকটা কষ্ট পেত। চলে যাওয়ার আগে আমাকে বহুবার বলেছে, তাঁর ঢাক যেন তেঘড়িপাড়া বারোয়ারিকে দেওয়া হয়। কেননা প্রথম থেকে ওই ঢাকেই তেঘড়িপাড়ার মায়ের পুজো হচ্ছে। আমি স্বামীর সেই কথা পালন করলাম মাত্র।”
পুজো কমিটির অন্যতম গোরা ভট্টাচার্য বলেন, “আমার জন্মের আগে থেকে আনন্দদা এখানে ঢাক বাজিয়েছেন। ওঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল অন্যরকম। মারা যাওয়ার পর আমরা তাঁর দেহ নবদ্বীপের শ্মশানে এনে সৎকারের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু আনন্দদা যে আমাদের এত বড় সম্মান দিয়ে যাবেন তা ভাবতে পারিনি।” কমিটির সম্পাদক লক্ষ্মী চট্টোপাধ্যায় বলেন, “শেষের দিকে আনন্দদা আর চোখে দেখতে পেতেন না। আমরা ধরে ধরে মণ্ডপের সামনে বসিয়ে দিতাম। হাত দিয়ে ছুঁয়ে বুঝে নিতেন ঢাকটা কোথায় আছে। তারপর শুরু হত অনবদ্য বাজনা।” ঢাক ও আনন্দবাবুকে নিয়ে পুজো কমিটির কর্তারা যখন স্মৃতিচারণে ব্যস্ত তখন তাঁদের থামিয়ে দেন শান্তিদেবী, “কে বলেছে তোমাদের দাদা আর নেই। তাঁর ঢাক বেজে উঠলেই মনে হবে, তিনি আছেন। পুজোর সময় আমিও আসব এখানে।”
লালু মোদকের দোকানে শান্তিদেবীকে ঘিরে থাকা পুজো কমিটির কর্তাদের অনেকেরই চোখ তখন ছলছল করছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রবীণ গোরাবাবু বলে উঠলেন, “আমাদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল গো আনন্দদা।” বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে।
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy