Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

মদের ঠেকের প্রতিবাদ, প্রহৃত শিক্ষক

সকাল থেকেই মদের ঠেকে শুরু হয় লোকজনের আনাগোনা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মদ্যপদের অত্যাচার। সোমবার রাতে তা এতটাই চরমে ওঠে যে চুপ করে আর বাড়িতে বসে থাকতে পারেননি কলেজ শিক্ষক শ্রীজয় মণ্ডল। সটান মদের ঠেকে গিয়ে প্রতিবাদ করেন তিনি। আর সেই ‘অপরাধে’ প্রতিবাদী ওই কলেজ শিক্ষককে বেধড়ক মারধর করে মাথা ফাটিয়ে দিল মদের ঠেকের কারবারি ও মদ্যপরা। ফরাক্কার অর্জুনপুর কান্তর মোড়ের ওই ঘটনায় পুলিশে অভিযোগ জানানো হলে দুষ্কৃতীরা বাড়িতে এসে ওই শিক্ষককে শাসিয়ে গিয়েছে, ‘রাস্তায় বেরোলেই গুলি করে মারব। দেখি কোন পুলিশের বাবা তোকে বাঁচায়?’

প্রহৃত শ্রীজয় মণ্ডল। —নিজস্ব চিত্র।

প্রহৃত শ্রীজয় মণ্ডল। —নিজস্ব চিত্র।

বিমান হাজরা
ফরাক্কা শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

সকাল থেকেই মদের ঠেকে শুরু হয় লোকজনের আনাগোনা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মদ্যপদের অত্যাচার। সোমবার রাতে তা এতটাই চরমে ওঠে যে চুপ করে আর বাড়িতে বসে থাকতে পারেননি কলেজ শিক্ষক শ্রীজয় মণ্ডল। সটান মদের ঠেকে গিয়ে প্রতিবাদ করেন তিনি। আর সেই ‘অপরাধে’ প্রতিবাদী ওই কলেজ শিক্ষককে বেধড়ক মারধর করে মাথা ফাটিয়ে দিল মদের ঠেকের কারবারি ও মদ্যপরা। ফরাক্কার অর্জুনপুর কান্তর মোড়ের ওই ঘটনায় পুলিশে অভিযোগ জানানো হলে দুষ্কৃতীরা বাড়িতে এসে ওই শিক্ষককে শাসিয়ে গিয়েছে, ‘রাস্তায় বেরোলেই গুলি করে মারব। দেখি কোন পুলিশের বাবা তোকে বাঁচায়?’

ফরাক্কার অর্জুনপুর-সহ আশপাশের এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরেই রমরমিয়ে চলছে একাধিক মদের ঠেক। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মূলত ওই ঠেকগুলোতে চলে দিশি মদের কারবার। পাড়ার মধ্যেই গজিয়ে ওঠা ওই ঠেকগুলোতে সকাল থেকেই ভিড় করে মদ্যপ ও সমাজবিরোধী লোকজন। স্থানীয় বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে একাধিকবার পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ তো কিছুই হয়নি, বরং ঠেকের সংখ্যা আরও কিছু বেড়েছে। বছর কয়েক আগে বেআইনি এইসব ঠেকের দৌরাত্ম্য রুখতে অর্জুনপুরের জনাকয়েক যুবক একটি প্রতিবাদ মঞ্চও তৈরি করেন। ফরাক্কা সৈয়দ নুরুল হাসান কলেজের বাংলার শিক্ষক শ্রীজয়বাবু ছিলেন ওই মঞ্চের অন্যতম প্রধান হোতা। কিন্তু বছর না ঘুরতেই ঝামেলা এড়াতে সেই মঞ্চ থেকে এক এক করে প্রায় সকলেই চলে গেলেও হাল ছাড়েননি শ্রীজয়বাবু।

মদের ঠেকের বিরুদ্ধে কার্যত একাই লড়ছিলেন তিনি। ইতিমধ্যে পুলিশের কাছে বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকবার লিখিত অভিযোগও জানিয়েছিলেন ওই শিক্ষক। নাম কা ওয়াস্তে পুলিশ এসে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরের দিন সকালে বাড়ি ফিরে নতুন উদ্যোগে ফের তারা মদের ঠেক চালু করে দিয়েছে। শ্রীজয়বাবুর বাড়ির পাশেই রয়েছে একটি মদের ঠেক। সেখানে মদ্যপদের অত্যাচার দিনের পর দিন বেড়েই চলেছিল। সোমবার কলেজ থেকে ফিরে বাড়িতেই ছিলেন শ্রীজয়বাবু। কিন্তু সেই ঠেক থেকে ভেসে আসা চিৎকার, অশ্রাব্য কথাবার্তা শুনে চুপ করে আর বাড়িতে বসে থাকতে পারেননি তিনি। মায়ের নিষেধ অগ্রাহ্য করে একাই তিনি ওই ঠেকে গিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। অভিযোগ, ঠেকের কারবারি সহ বেশ কয়েকজন মদ্যপ দুষ্কৃতী শ্রীজয়বাবুকে বেধড়ক মারধর করে। তাঁর মাথা ফেটে যায়। স্থানীয় অর্জুনপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলে মাথায় পাঁচটি সেলাই পড়ে। ওই রাতেই খবর পেয়ে পুলিশ এসে ওই ঠেক ভেঙে দিলেও এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। ফরাক্কা থানার পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্তদের ধরতে ওই এলাকায় বেশ কয়েকবার হানা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের ধরা যায়নি।

শ্রীজয়বাবুর মা ঊষারানি মণ্ডল বলেন, “সকাল থেকেই বাড়ির পাশে বসে মদের আসর। স্বামী, ছেলেরা সবাই নিজের কাজে চলে যায়। তাই সব কিছুই চুপ করে সহ্য করতে হয়। শ্রীজয় এই নিয়ে প্রতিবাদ করায় আমার খুব ভয় করত।”সোমবার রাতে ঊষারানিদেবীর সেই আশঙ্কাই সত্যি হল। শ্রীজয়বাবু বলছেন, “ওই ঠেকের পাশেই একটি হাইস্কুল রয়েছে। ইদানীং স্কুলের কিছু ছেলেকেও ওই ঠেকে দেখেছি। পুলিশ-প্রশাসন অবিলম্বে এইসব বেআইনি ঠেকগুলো বন্ধ না করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।” তিনি বলেন, “সোমবার রাতের ওই ঘটনার পর মঙ্গলবার সকালে আমার ভাই থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ জানিয়ে আসে। তারপরেই বাড়িতে এসে কয়েকজন দুষ্কৃতী আমাকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে বলে শাসিয়ে যায়। ওরা পুলিশকেও ভয় না। এত সাহস ওরা কোথা থেকে পাচ্ছে?”

মদের ঠেকের এই রমরমার জন্য অনেকে কিন্তু দায়ী করছেন পুলিশকেই। তাঁদের অভিযোগ, “পুলিশের প্রচ্ছন্ন মদতেই এই ঠেকগুলো চলছে। না হলে পুলিশের চোখের সামনে এগুলো চলছে কী করে?” ফরাক্কার তৃণমূলের নেতা সোমেন পাণ্ডে বলেন, “ফরাক্কায় মদের কারবারিদের দৌরাত্ম্য কতটা বেড়েছে এই ঘটনা থেকেই তা পরিষ্কার। শুধু অর্জুনপুরেই নয়, এনটিপিসি মোড়, নয়নসুখ, জাফরগঞ্জ, নিউ ফরাক্কা এলাকাতেও মদের ঠেক চলছে। স্থানীয় বাসিন্দারা ভয়ে কেউ প্রতিবাদও করেন না। আমি নিজে বহু বার ফরাক্কা থানায় এই সব ঠেক বন্ধ করার জন্য পুলিশকে অনুরোধ করেছি। কিন্তু পুলিশ সক্রিয় নয় বলেই এই ঠেকগুলো চলছে।”

অর্জুনপুরেরই বাসিন্দা প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ আবুল হাসনাত খান বলেন, “পুলিশ যখন নিষ্ক্রিয় তখন জনমত তৈরি করে শ্রীজয়ের মতো একসঙ্গে পথে নামতে হবে আমাদের সবাইকে। তবেই এসব বন্ধ হবে।”

জেলা পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর অবশ্য বলেন, “পুলিশকে বহু বার বলা হয়েছে এলাকার সমস্ত মদের অবৈধ ঘাঁটি ভেঙে দিতে। এ ব্যাপারে স্থানীয় পুলিশ কাজ না করলে আমাকে জানান। আমি অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

hooch den biman hazra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE