কৃষ্ণনগর জেলা সংশোধনাগার থেকে বেরিয়ে আসছেন প্রদীপ সাহা। পাশে বাবা, বোন ও স্ত্রী। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
সকাল থেকেই সাজো সাজো রব। রোজকার চেনা ছবিটার সঙ্গে বুধবার কিছুতেই মেলানো যাচ্ছিল না নবদ্বীপ আদালত চত্বরকে।
আদালতে যাওয়ার সরকারপাড়া রোডে আদালতের আগে আধ কিলোমিটার জুড়ে পুলিশের নিশ্ছিদ্র পাহারা। কড়া হাতে নিয়ন্ত্রিত যানবাহন। আদালতের মূল ফটকে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে আপদমস্তক পরীক্ষার পরে ভিতরে ঢোকার অনুমতি। আদালত চত্বর ছয়লাপ সশস্ত্র পুলিশে। থমথমে আদালত চত্বরে সকাল ১০টার আগে থেকেই ভিড়ে ভরা। সজল ঘোষ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা নিয়ে এমনই ছিল এ দিনের আদালতের চিত্র।
গত ১৯ নভেম্বর মামলার শুনানি শেষে রায়ের দিন ঘোষণা করেন বিচারক সুধীর কুমার। সেই মতো সকলেই তড়িঘড়ি আদালতে পৌঁছতে চেষ্টা করেন। তবে এত চর্চিত মামলার রায় যে এত সংক্ষেপে ও তাড়াতাড়ি ঘোষণা হবে, অনেকেই আঁচ করতে পারেননি। তাই বুধবার সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ যখন রায় ঘোষণা হয়ে গিয়েছে, তখনও অনেকে আদালতের পথে। এ দিন সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে প্রদীপ সাহাকে কৃষ্ণনগর সংশোধনাগার থেকে আদালতে আনা হয়। পরপর এসে পৌঁছন প্রদীপবাবুর মা,বাবা, স্ত্রী-সহ পরিবারের সদস্যেরা। আসেন সিপিএম নেত্রী অঞ্জু কর-সহ নবদ্বীপ ও বর্ধমানের বহু সিপিএম নেতানেত্রী। মামলা চলাকালীন তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেলেও এ দিন আদালতে কাজল শেখ এবং হাতে গোনা কয়েক জনকে দেখা গিয়েছে। প্রদীপবাবুর আইনজীবীদের মধ্যে প্রতিম সিংহরায় এবং সামসুল ইসলাম মোল্লা উপস্থিত ছিলেন। মামলায় সরকার পক্ষের আইনজীবী, নদিয়ার অতিরিক্ত সরকারি কৌসুঁলি বিকাশকুমার মুখোপাধ্যায় অবশ্য ছিলেন না। রায় ঘোষণা হয় নবদ্বীপের সরকারি কৌঁসুলি সনৎকুমার রায়ের উপস্থিতিতে।
সকাল ১০.৩৫ নাগাদ এজলাসে আসেন অতিরিক্ত এবং সেশন জজ সুধীর কুমার। কিছুক্ষনের মধ্যে হাজির করানো হয় সাদা শার্ট ও রঙিন হাফহাতা সোয়েটার পরা প্রদীপবাবুকে। একে একে হাজির করানো হয় অপর অভিযুক্ত সন্তু ভৌমিক, সোরাবুদ্দিন মণ্ডল, হানিফ শেখদের। কিন্তু আর এক অভিযুক্ত সরফুদ্দিন মণ্ডলকে ডেকে-ডেকেও পাওয়া যায় না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বিচারক এ দিন অন্য একটি মামলার শুনানি শুরু করেন। কিছু পরে সরফুদ্দিন নিজেই হাজির হলে সওয়া ১১টা নাগাদ ফের ডাকা হয় প্রদীপ সাহা-সহ পাঁচ অভিযুক্তকে। ততক্ষণে ভিড়ে থিকথিক করছে আদালত কক্ষ ও চওড়া বারান্দা। সকলে হাজির হতেই বিচারক ঘোষণা করেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তাই তাঁদের অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হল। সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা পর্বে অনেকেই হকচকিয়ে যান। তার পরেই উল্লাসে ফেটে পড়েন প্রদীপবাবুর পরিজনেরা। এরই মধ্যে পুলিশ প্রদীপবাবুকে এজলাস থেকে নিয়ে চলে যায়।
প্রদীপবাবুর স্ত্রী শম্পাদেবী বলেন, “তিন বছর ধরে দাঁতে দাঁত চেপে এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। অনেক অসম্মান, অপমানের উত্তর আজ মিলল। আমার আইনের উপর ভরসা রেখেছিলাম। আজ আবার প্রমাণ হল, মিথ্যে শেষ কথা বলে না। আমার সবাই খুশি।” আদালত চত্বরেই কান্নায় ভেঙে পড়েন প্রদীপবাবুর মা দীপালিদেবী। চোখে জল প্রদীপবাবুর ছোট ভাই ও বোনেরও। তাঁর বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী মণীন্দ্রচন্দ্র সাহা বলেন, “এই তিন বছর ধরে একটা দ্বন্দ্বে কাটিয়েছি। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল প্রদীপ সসম্মানে মুক্তি পাবে।”
অতিরিক্ত সরকারি কৌসুঁলি বিকাশবাবু বলেন, “আমরা খুশি নই। রায়ের কপি হাতে পেলেই হাইকোর্টে আপিল করব।” প্রদীপবাবুর আইনজীবী প্রতিমবাবু অবশ্য এই রায়কে ‘ধর্মের জয়’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “প্রথম দিন থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম, মিথ্যা অভিযোগ থেকে প্রদীপবাবুকে মুক্ত করতে পারব। মাননীয় আদালতের কাছে সুবিচার পেয়েছি।” রায় ঘোষণার পরেই প্রদীপবাবুকে কৃষ্ণনগরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল ৪টে নাগাদ সেখান থেকে ছাড়া পান তিনি। পরিজনদের সঙ্গে পা বাড়ান বাড়ির পথে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy