Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

জীবনে ইতি টানার অধিকার কি আজকের?

রামচন্দ্র নিজে সরযূ নদীতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। মহাভারতের শেষে স্বেচ্ছায় জীবন ত্যাগ করেন বিদুর। যে ব্যক্তি বেদান্তজ্ঞানের অধিকারী, সংসারের অনিত্যতাকে জেনেছেন, তিনি স্বেচ্ছায় প্রাণ বিসর্জন দিলে তা বৈধ। অত্রিসংহিতা জানাচ্ছে, রোগের কবলে কেউ আত্মহনন করলে তা দোষের নয়।জীবনে ইতি টানার অধিকার কি আজকের? রামচন্দ্র নিজে সরযূ নদীতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। মহাভারতের শেষে স্বেচ্ছায় জীবন ত্যাগ করেন বিদুর। যে ব্যক্তি বেদান্তজ্ঞানের অধিকারী, সংসারের অনিত্যতাকে জেনেছেন, তিনি স্বেচ্ছায় প্রাণ বিসর্জন দিলে তা বৈধ। অত্রিসংহিতা জানাচ্ছে, রোগের কবলে কেউ আত্মহনন করলে তা দোষের নয়।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

শামিম আহমেদ
শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৮ ২২:৫৮
Share: Save:

মহাভারতকার কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের প্রপিতামহ বশিষ্ঠ আত্মহত্যা করবেন বলে লতাপাতা দিয়ে নিজের হাত-পা বেঁধে বর্ষার জলে পূর্ণ এক খরস্রোতায় ঝাঁপ দিলেন। নদী তাঁর সব বন্ধন ছিন্ন করে তাঁকে তীরে ছেড়ে দিল। পাশমুক্ত বশিষ্ঠ সেই নদীর নাম রাখলেন ‘বিপাশা’। বিশ্বামিত্রের চক্রান্তে কল্মাষপাদ রাক্ষস (আসলে তিনি রাজা সৌদাস) বশিষ্ঠের শত পুত্রকে ভক্ষণ করেছে জেনে মুনিপ্রবর আত্মহত্যার ইচ্ছা করলেন। এক দিন হিমালয় থেকে এক নদীতে ঝাঁপ দিলেন কিন্তু নদী বশিষ্ঠকে অগ্নিতুল্য ভেবে তীরে তুলে দিয়ে শতগুণ বেগে প্রস্থান করল— সেই নদীর নাম ‘শতদ্রু’। ইচ্ছে করলেই স্ববধ সম্ভব হয় না, তিনি আশ্রমে ফিরে এসে জানতে পারলেন— তাঁর নিহত পুত্র শক্ত্রির স্ত্রী অদৃশ্যন্তী গর্ভবতী। অদৃশ্যন্তী প্রসব করেন পরাশর মুনিকে, যিনি ব্যাসদেবের পিতা।

মহাভারতে স্ববধকে সব সময় ভাল চোখে দেখা হয়নি। স্মৃতিশাস্ত্র ও পুরাণে বৈধ এবং অবৈধ এই দুই প্রকার আত্মহত্যার কথা বলা হয়েছে। নিষ্কৃতি মৃত্যুকে বৈধ আত্মহত্যার পর্যায়ে ফেলা হয়। অবৈধ আত্মহত্যা কী রকম? মহাভারতের টীকাকার নীলকন্ঠ ‘ভারতভাবটীকা’-য় বলছেন, যারা আত্মঘাতী তারা অসুরলোকে গমন করে (বনপর্ব, ৭০.৮৩)। যদি কেউ ক্রোধবশত বা স্নেহবশত কিংবা মান-অভিমানের কারণে আত্মহনন করে, সেই আত্মহত্যা হবে অবৈধ এবং আত্মঘাতী নরকে যাবে, ঈশোপনিষদেও এমন কথা পাওয়া যায়। এমন স্বেচ্ছামৃত্যুতে মানুষের বিচারবোধ কাজ করে না। মহাভারত এমন আত্মহত্যার নিন্দা করেছে। এমনকি এই ধরনের আত্মঘাতীদের পারলৌকিক কর্মে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। যাঁরা পারলৌকিক কাজ করবেন, পরের জন্মে তাঁরা ইতরযোনিতে জন্মগ্রহণ করবেন। ওই শবদেহ শেয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খাবে, যাতে সেই দৃশ্য দেখে জীবিত ব্যক্তিরা অবৈধ আত্মহত্যাকে পরিহার করার শিক্ষা পান।

বৈধ আত্মহত্যা কী রকম?

অনুশাসনপর্ব, শল্যপর্বে বৈধ আত্মহত্যার কথা পাওয়া যাচ্ছে। বৈধ আত্মহত্যার আবার তিনটি প্রকার। প্রথমটির কথা আপাতত বলা যাক। যে ব্যক্তি বেদান্ত জ্ঞানের অধিকারী, সংসারের অনিত্যতাকে সংশয় ও বিপর্যয়হীন চিত্তে জেনেছেন, তিনি যদি নিজের ইচ্ছায় জীবনের প্রতি বীতরাগবশত কোনও পবিত্র স্থানে অনশনের দ্বারা প্রাণ বিসর্জন দেন, তবে সেই স্ববধ হবে বৈধ। টীকাকার নীলকন্ঠ অনুশাসনপর্বে বলছেন, শারীরিক পীড়া বা ক্লেশজনিত কারণে এই আত্মহত্যা করা যাবে না।

বিখ্যাতো হিমবান্ পুণ্য শঙ্করশ্বশুরো গিরিঃ।

আকরঃ সর্বরত্নানাং সিদ্ধাচারেণসেবিতঃ।।

শরীরমুৎসৃজেত্তত্র বিধিপূর্বমনাশকে।

অধ্রুবং জীবিতং জ্ঞাত্বা যো বৈ বেদান্তগো দ্বিজ।।

অভ্যর্চ্য দেবতাস্তত্র নমস্কৃত্য মুনীংস্তথা।

ততঃ সিদ্ধো দিবং গচ্ছেদ্ ব্রহ্মলোকং সনাতনম্।।

—বিখ্যাত হিমবান্ পুণ্য শঙ্করশ্বশুর গিরি হলেন সমস্ত রত্নের মণি ও সিদ্ধাচারসেবিত। যিনি বেদান্ত পারদর্শী ব্রাহ্মণ হন এবং জীবনকে অধ্রুব জেনে সেই পবিত্র তীর্থস্থানে বিধিপূর্বক শরীর ত্যাগ করেন। সেইখানে দেবতাদের পূজা করে এবং মুনিদের নমস্কার করে সিদ্ধ ব্যক্তি সনাতন ব্রহ্মলোকস্বরূপ স্বর্গে গমন করেন। এখানে আত্মহত্যার উদ্দেশ্য মোক্ষলাভ।

শল্যপর্বে আছে, সরস্বতীর উত্তর তীরে যে নিজ দেহ বিসর্জন দেয়, তার আর মৃত্যু দুঃখ প্রভৃতি অনুভব হয় না। মহাভারতে সহমরণের গুণাগুণ বর্ণনা করা হয়েছে এবং এই স্ববধকেও বৈধ বলা হয়েছে। তবে বলপ্রয়োগ করে বিধবাদের চিতায় তোলা হত না। সত্যবতী, কুন্তী, উত্তরা এবং বহু কুরুবিধবাই তার প্রমাণ।

আরও পড়ুন: বেদে সর্বোচ্চ নম্বর, তবু ক্লাসের বাইরে

দ্বিতীয় প্রকারের বৈধ আত্মহত্যা পাপজনিত কারণে সাধিত হতে পারে। কেউ যদি মহাপাপ করে তবে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে। সেই স্ববধও বৈধ। মহাপাপ কী? মাতৃগমন বা ভগ্নীগমনের মতো মহাপাপ করলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে। এই স্ববধের উদ্দেশ্য মোক্ষপ্রাপ্তি নয়, পাপের প্রায়শ্চিত্ত এর লক্ষ্য। মহাভারতে অজাচার সম্পর্কের নিন্দা করা হয়েছে। পিতা-পুত্রীর, মাতা-পুত্রের, ভ্রাতা-ভগ্নীর যৌন সম্পর্ক অজাচার। মহাকাব্যে গুরুপত্নীও অগম্যা, বিমাতা-গমনও অজাচার। ভগ্নীগমন, মাতৃগমন ও গুরুতল্পগমন করলে তার প্রায়শ্চিত্ত আত্মহনন। ব্রহ্মহত্যার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিও তাই করবে। তবে শান্তিপর্বে গুরুপত্নীগমন নামক পাপের অন্য প্রায়শ্চিত্ত রয়েছে। দানের দ্বারা এই পাপ ক্ষয় হতে পারে। গরু, ভূমি এবং অর্থদানই সে ক্ষেত্রে প্রায়শ্চিত্ত।

গাশ্চ ভূমিঞ্চ বিত্তঞ্চ দত্ত্বেহ ভৃগুনন্দন।

পাপকৃৎ পূয়তে মর্ত্ত্য ইতি ভার্গব শুশ্রুম।। (অনুশাসনপর্ব)

—হে ভৃগুনন্দন ভার্গব! এ রকম আমরা শুনি যে, এই সংসারে গবাদিপশুসমূহ, ভূমি এবং বিত্ত দান করে পাপকারী মর্ত্যবাসী পবিত্র হল।

বৈধ আত্মহত্যার তৃতীয় প্রকারটি বেশ চমকপ্রদ। কেবলমাত্র রোগের কারণে আত্মহত্যা শাস্ত্রসম্মত, যাকে আমরা নিষ্কৃতি মৃত্যু আখ্যা দিতে পারি। অনুশাসনপর্বের একটি টীকাতে নীলকন্ঠ বলছেন, “ইতরেষাং ত্বিহ মরণং রোগাদিমহানিমিত্তে সত্যেব মহাপাতকপ্রায়শ্চিত্তার্থং বা উচিতম্।”

শুধু মহাভারতে এর আভাস পাওয়া যায়, এমন নয়। এই বিষয়ে বহু স্মৃতিবচন রয়েছে। অত্রিসংহিতায় পাওয়া যায়:

বৃদ্ধং শৌচস্মৃতের্লুপ্ত প্রত্যাখ্যাতভিষক্‌ক্রিয়ঃ।

আত্মানং ঘাতয়েদ্যস্ত ভৃগ্বগ্ন্যনশনাম্বুভিঃ।।

তস্য ত্রিরাত্রমশৌচং দ্বিতীয়ে ত্বস্থিসঞ্চয়ম্।

তৃতীয়ে তূদকং কৃত্বা চতুর্থে শ্রাদ্ধমাচরেৎ।।

—যে বৃদ্ধের শৌচাশৌচজ্ঞান নেই এবং বৈদ্যরা যাকে প্রত্যাখ্যান করেছে এই ভেবে যে তার রোগ অনুপশমনীয়; সে যদি পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে, আগুনে প্রবেশ করে এবং অনশনের দ্বারা আত্মহনন করে তবে তা দোষযুক্ত হবে না। তার ত্রিরাত্র অশৌচ হবে এবং চতুর্থ দিনে শ্রাদ্ধ প্রভৃতি হবে।

এই ধরনের আত্মহত্যা মানবিক। ধর্মশাস্ত্রসমূহে এবং মহাভারতে এমন স্ববধ মোক্ষলাভ বা পাপস্খলনের জন্য নয়, বরং তা জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। এই আত্মহত্যা যেহেতু অনুপশমনীয় রোগের কারণে, তাই তৎকালীন চিকিৎসাশাস্ত্রের নৈতিক অবস্থানটিও দেখে নেওয়া প্রয়োজন। সভাপর্বে চিকিৎসাবিদ্যার কথা আছে। রোগ হলে চিকিৎসা এবং সেবাশুশ্রূষা করতে হয়। আদিপর্বে উল্লেখ আছে, সুহৃদ ব্যক্তিগণ শুশ্রূষার ভার গ্রহণ করবেন। সভাপর্বে আছে, রাজার চেষ্টায় এবং সর্ববিধ অনুকূলতায় চিকিৎসাশাস্ত্র উন্নত হয়। অর্থাৎ চিকিৎসা ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একটি বড় ভূমিকা আছে। প্রাচীন কালে কৃষ্ণাত্রেয়-মুনির কাছে চিকিৎসাশাস্ত্র প্রতিভাত হয়েছিল (শান্তিপর্ব)। এই আয়ুর্বেদ অথর্ববেদের অন্তর্গত। যদিও কেউ কেউ বলেন, এটি ঋগ্বেদের উপবেদ, শস্ত্রশাস্ত্র হল অথর্ববেদের উপবেদ। এই মত চরণব্যূহের। প্রজাপতি থেকে সূর্য, তার পর ধন্বন্তরি প্রমুখ শিষ্য হয়ে চরকের কথা মহাভারতে পাওয়া যায়। মহাভারতের আদিপর্বে সুশ্রুতের উল্লেখ আছে— তাঁর পিতা বিশ্বামিত্র। আয়ুর্বেদ আচার্যদের যে চিকিৎসানীতি, সেই অনুযায়ী, অনুপশমনীয় রোগে ভোগা ব্যক্তিদের নিষ্কৃতি মৃত্যু কতটা গ্রহণযোগ্য? পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার নীতিশাস্ত্র চারটি নীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত—প্রথমটি হল অটোনমি, নিজের শরীরের প্রতি অধিকার, নিজের পছন্দকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা। রোগীর সিদ্ধান্তের প্রতি চিকিৎসকদের শ্রদ্ধা থাকবে। চরকের বৈদ্যবৃত্তি, মৈত্রী, করুণা, শক্যস্যপ্রীতি, উপেক্ষণম প্রভৃতি শব্দগুলো অটোনমির নানা দিককে প্রকাশ করে। দ্বিতীয় নীতির নাম beneficence—সুশ্রুতের ‘যোগ্যসূত্র’-এ যে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের কথা আছে তাই হল beneficence। রুগির যাতে সবচেয়ে ভাল হয়, বৈদ্য বা ডাক্তার সেই মতো কাজ করবেন। চিকিৎসক রুগির কোনও ক্ষতি করবেন না, এটি হল তৃতীয় নিয়ম, যাকে বলা হয় non-maleficence। চরকের পাঠ্যাপাঠ্য কল্পনায় এই নিয়ম আছে। চতুর্থ নিয়ম হল justice, বৈদ্যরা যার নাম দিয়েছেন ‘কল্যাণ’, সুশ্রুত একে বলেছেন ‘বন্ধুভূতেন’। যে সমস্ত দেশ চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই নীতি অক্ষরে অক্ষরে মানে, তারা অনেকে নিষ্কৃতি মৃত্যুকে বৈধতা দিয়েছে। আধুনিক ভারতে এই নিষ্কৃতি মৃত্যুর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ স্বীকৃতি ছিল না। কিন্তু তাতেও আত্মহত্যা (‘বৈধ’ বা ‘অবৈধ’) কমেনি। প্রতি ঘণ্টায় এই দেশে ১৫ জন আত্মহত্যা করেন। পৃথিবীতে ৪০ সেকেন্ড অন্তর এক জন আত্মহননের পথ বেছে নেন। জীবন যখন ভয়ংকর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, জীবনের যন্ত্রণা যখন সহ্যের বাইরে চলে যায়, তখন মৃত্যুর মধ্যে অনেকে মুক্তি খোঁজেন। বাঁচার ইচ্ছাকে অস্বীকার করেই তাঁরা এই স্বাধীনতা খোঁজেন। জীবন যেহেতু ব্যক্তির তাই মৃত্যুর অধিকারও তার একান্তই ব্যক্তিগত। আত্মহত্যার বিরুদ্ধেও কম যুক্তি নেই। মহাভারত এবং নানা ধর্মশাস্ত্রে অবৈধ ও বৈধ আত্মহত্যার ভেদ করে এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু মৃত্যু তো অজ্ঞাত এবং অজ্ঞেয়, তাকে লক্ষ্য করে কী ভাবে আত্মহননকারী এগিয়ে যায়? সে বলে, জীবনের আগে ব্যক্তির যে অনাদি অনস্তিত্ব আর মৃত্যুর পরে ব্যক্তির যে অনন্ত অনস্তিত্ব তার মধ্যে ফারাক নেই। মৃত্যু আসলে সেই অনাদি-অনন্ত সময় নামক আত্মায় মিশে যাওয়া।

মহাভারতে মৃত্যু হল ইহলোক ও পরলোকের সেতু। তবে নাস্তিক যেহেতু পরলোক মানেন না, তিনি মৃত্যুতেই সব শেষ বলেন। ইহলোক আর পরলোকে যে ধন প্রদান করে সেই হল ধর্ম। মৃত্যুর প্রসঙ্গে তাই অনিবার্যভাবে এসে পড়েন ধর্ম স্বয়ং। এই ধর্মই হল নৈতিকতা, যা স্থিতি বা ভারসাম্য রক্ষার কথা বলে। মৃত্যু দুই লোকের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার উপায় বলে অনেকের বিশ্বাস।

মহাভারতে মৃত্যু হলেন এক জন অধিদেবতা, তিনি নারী। মৃত্যুর জন্ম আছে। তিনি ব্রহ্মার ক্রোধ থেকে জন্মেছেন। ব্রহ্মার ছয় পুত্রের বংশে পৃথিবী যখন ভারাক্রান্ত, তখন ব্রহ্মা গেলেন রেগে। মৃত্যুর জন্ম হল। ব্রহ্মা তাঁকে বললেন, যাও! সংহার করো। মৃত্যুদেবী পাপভয়ে হননকার্যে ব্রতী হলেন না, তিনি ব্রহ্মাকে বললেন, আমাকে ক্ষমা করুন। কেঁদে কেঁদে তাঁর দু’টি চক্ষু রক্তিম বর্ণের হয়ে গেল। ব্রহ্মা বললেন, মানুষ তার বাসনার চক্রে পড়ে মরবে, তোমার কোনও পাপ হবে না; তোমার সাহায্যকারী হবেন জরা আর যম।

সমস্যা দেখা দিল জরা আর যমকে নিয়ে। জরা এসে কুরে কুরে খাচ্ছে মানুষকে, সে ছেড়ে যাবে না কিছুতেই। তখন যম যদি নিজে না আসেন, তাঁকে ব্যক্তি নিজেই ডাকতে পারেন অথবা নিজেই পালন করতে পারেন যমের ভূমিকা। সেই তো নিষ্কৃতি মৃত্যু! মৃত্যুর জন্ম জীবননাশের উদ্দেশে। তবে শাস্ত্রমতে মানুষ চলে কর্মবাদের নিয়মে। অপূর্ব, অদৃষ্ট বা ঋতের অমোঘ নিয়মে চলে জীবন নামক যজ্ঞ। মানুষের কর্মবাদ অনুযায়ী তাকে জন্মাতে হয়, মরতে হয় কিংবা পুনরায় জন্মলাভ করতে হয়। প্রারব্ধ, সঞ্চিত ও সঞ্চীয়মান—এই তিন প্রকার কর্ম। প্রারব্ধ কর্মের শেষ না হওয়া পর্যন্ত শরীরের বিনাশ হয় না। শাস্ত্র অনুযায়ী, মৃত্যু আকস্মিক নয়; এমনকি আত্মহত্যা বা নিষ্কৃতি মৃত্যুও পূর্বনির্ধারিত, এমন ব্যাখ্যাও কেউ কেউ দিয়ে থাকেন।

মহাভারতের বনপর্বে দেখা যায়, বিষভক্ষণ, অগ্নিপ্রবেশ, জলে ডোবা এবং উদ্‌বন্ধন—এই ক’টি আত্মহত্যার উপায় সেই সময় লোকসমাজে জানা ছিল— বিষমগ্নিং জলং রজ্জুমাস্থাস্যে তব কারণাৎ। প্রায়োপবেশন, জৈনরা যাকে বলেন ‘সন্তর’ বা ‘সাল্লেখানা’, তাও স্ববধের একটি উপায়। এমন উপায়েও অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। ভগবান রামচন্দ্র সরযূ নদীতে আত্মাহুতি দিয়েছেন। মহাভারতের নিষ্কৃতি বা স্বেচ্ছামৃত্যুর কথা উঠলেই দেবব্রত ভীষ্মের কথা প্রথমেই মনে আসে।

অষ্টবসুর অন্যতম ‘দ্যূ’ বশিষ্ঠের কামধেনু চুরির দায়ে সাত ভাইয়ের সঙ্গে মর্ত্যযন্ত্রণার অভিশাপ পান। গঙ্গার সঙ্গে আট বসুর চুক্তি হয়, জন্মানো মাত্র তিনি পুত্রদের নিষ্কৃতি মৃত্যু দিয়ে মর্ত্যযন্ত্রণা দূর করবেন। কিন্তু পিতা শান্তনুর চেষ্টায় অষ্টম পুত্র বেঁচে যান এবং তাঁর নাম হয় দেবব্রত ভীষ্ম। তিনি ইচ্ছামৃত্যু ও যুদ্ধে অবধ্য হওয়ার বর পেয়েছিলেন। বহু দিন বাঁচার পর, নানা ঘাত-প্রতিঘাতে জীবন অতিবাহিত করে ভীষ্ম নামলেন মহাযুদ্ধে। কিন্তু প্রতিপক্ষ পাণ্ডবদের বলে দিলেন তাঁকে বধ করার উপায়। ভীষ্মের কথা মতো শিখণ্ডীকে অগ্রবর্তী করে যুদ্ধে নামলেন অর্জুন, প্রতিপক্ষ ভীষ্ম। দ্রুপদ-সন্তান শিখণ্ডী ছিলেন রূপান্তরকামী— তিনি নারী হয়ে জন্মান, পরে যক্ষ স্থূণাকর্ণের সঙ্গে লিঙ্গ বিনিময় করে পুরুষ হন। ভীষ্মদেব রূপান্তরকামীর উদ্দেশে শর নিক্ষেপ করবেন না, এই ছিল তাঁর যুদ্ধের অন্যতম নীতিধর্ম। একের পর এক বাণ এসে ভীষ্মের শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলল। শারীরিক ও মানসিক ভাবে নিপীড়িত, তিনি জীবনের প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়লেন। যুধিষ্ঠিরকে ডেকে বললেন, আমার এই দেহের প্রতি বিরাগ জন্মেছে। পাণ্ডবরাও তাই চেয়েছিলেন। ইচ্ছামৃত্যু ও যুদ্ধে অবধ্যত্বের বর যাঁর, তাঁকে এই রণকৌশল ছাড়া পরাজিত ও নিহত করা সম্ভব নয়। ভীষ্ম যুদ্ধ বন্ধ করলেন। শিখণ্ডীর নয়টি বাণ বুকে আর অর্জুনের শতাধিক বাণ এসে তাঁর সারা শরীর ছেয়ে ফেলল। তিনি রথ থেকে পড়ে গেলেন। দেহ রইল শরের উপর, ভূমি স্পর্শ করল না। ভূতলে পতিত থেকে তিনি উত্তরায়ণের প্রতীক্ষায় রইলেন। অনুশাসনপর্বের শেষে তাঁর প্রাণবায়ু নিরুদ্ধ হয়ে ঊর্ধ্বগামী হয়। মৃত্যুর আগে দুর্যোধন শল্যচিকিৎসক এনে ভীষ্মের শরীর বাণমুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। পিতামহ সম্মত হননি। নিষ্কৃতি মৃত্যুর দ্বারস্থ হয়েছিলেন কি তিনি!

শেষ জীবনে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী ও সঞ্জয় অরণ্যে চলে যান। এক গভীর নির্জন বনে তপস্যায় বসেন তাঁরা। শান্ত সেই অরণ্যে হঠাৎ দাবানল জ্বলে উঠল। ধৃতরাষ্ট্র সেই আগুনে আত্মাহুতি দিলেন। গান্ধারী এবং কুন্তী তাঁকে অনুসরণ করলেন। জীবনের প্রয়োজন ফুরিয়েছে— এই কথা সম্যকভাবে অনুধাবন করার পর মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছিলেন নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী সঞ্জয়। যোগবলে দেহত্যাগ করেন তিনি। স্বয়ং ধর্ম বিদুর প্রায়োপবেশনে তিরোহিত হন। তাঁর দেহ নগ্ন, মলিন ও বনের ধূলিকণাতে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। স্বয়ং ধর্ম যখন আত্মহননের পথ অবলম্বন করেন, তখন বুঝতে হয়, মহাভারতীয় নীতিবিদ্যায় নিষ্কৃতি মৃত্যুর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mythology Euthanasia Ramayan Mahabharat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE