Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মানুষের কাজেই বিপন্ন মানুষের পড়শি

ময়ূর উপাসকদের মধ্যে অন্যতম চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, সর্প বন্দনাকারীদের মধ্যে বাসুকী নাগ, মহিষকুলে মহিষাসুর আর চড়ুই বংশে ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো! পাইরেট বংশে এমন বীরপুঙ্গবের উপাধি কিন্তু স্প্যারো, মানে পক্ষীকুলের এক নিরীহ ক্ষুদ্র ‘চড়ুই পাখি’।

চিত্রণ: অর্ঘ্য মান্না

চিত্রণ: অর্ঘ্য মান্না

সেবন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৭ ০২:৫২
Share: Save:

ময়ূর উপাসকদের মধ্যে অন্যতম চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, সর্প বন্দনাকারীদের মধ্যে বাসুকী নাগ, মহিষকুলে মহিষাসুর আর চড়ুই বংশে ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো! পাইরেট বংশে এমন বীরপুঙ্গবের উপাধি কিন্তু স্প্যারো, মানে পক্ষীকুলের এক নিরীহ ক্ষুদ্র ‘চড়ুই পাখি’। যে জ্যাক স্প্যারো বলে, কোন সমস্যাই সমস্যা নয়, সমস্যা হল কী ভাবে দেখছো তাকে!

তা বলে চড়ুইয়ের মতো একটা ছোট্ট পাখির জন্য একটা আস্ত দিন! চড়ুই দিবস যে হতে পারে, ক’বছর আগেও ভাবা যেত না। এ দেশের ‘নেচার ফরএভার সোসাইটি’ নামে এক সংগঠন ২০১০ সাল থেকে প্রত্যেক বছরের ২০ মার্চ এই দিন পালন করছে। ২০১১ সালের এই দিনে গুজরাতের আমদাবাদে শুরু হয় ‘স্প্যারো আওয়ার্ড’ প্রদান। এ পর্যন্ত ৪০টির বেশি দেশ বিশ্ব চড়ুই দিবস পালনে ও চড়ুই রক্ষায় এগিয়ে এসেছে। যে চড়ুই আমাদের সঙ্গে কার্নিশ, কড়িকাঠ, ঘুলঘুলি, জল বেরোবার ফুটোয় গা ঘেঁষাঘেঁষি করার অপরাধে পক্ষীকূলে নিন্দিত (রজনীকান্ত সেনের ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতায় চড়ুইকেই পাল্টা ঠেস দিয়ে বাবুই পাখি বলেছে, ‘বাবুই হাসিয়া কহে, সন্দেহ কি তাই/ কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়/ পাকা হোক, তবু ভাই পরের ও বাসা/ নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা’), সেই আমাদের অতি আহ্লাদে, প্রায় গায়ে পড়া পাখিটাই আজ বিপন্ন। বিপন্নতার কারণ তার পরম মিত্র মানুষই।

১৯৮০ সালের পর থেকে গোটা বিশ্বে চড়ুইয়ের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে অনেকটাই। এর একমাত্র কারণ, মানুষের কর্মকাণ্ড। নিয়ন্ত্রণহীন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার, ফসলে কীটনাশক দেওয়ায় চড়ুই তার খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শস্যদানা, ঘাসের বীজের ফাঁকে পোকার শূককীট, মুককীট বা লেদা পোকা খেয়ে ফসল বাঁচায় চড়ুই।

চড়ুই কমে যাওয়ার ফল কী হতে পারে, সেটা চিনের একটি ঘটনা থেকে বোঝা যায়। শোনা যায় ১৯৫৮ সালে মাও জে দং-এর নির্দেশে অজস্র চড়ুই হত্যা করা হয়। মনে করা হয়েছিল, চড়ুই ফসলের ক্ষতি করে। একটি চড়ুই বছরে ৪ থেকে ৫ কেজি শস্য খায়। সুতরাং দশ লক্ষ চড়ুইয়ের খাবার বাঁচাতে পারলে প্রায় ৬০ হাজার লোকের মুখে খাদ্য তুলে দেওয়া যাবে। তৈরি হল ‘স্প্যারো আর্মি’। রাষ্ট্রীয় নিধন যজ্ঞে শ’য়ে শ’য়ে চড়ুই আত্মহুতি দিল। ‘গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেন’ নামে চড়ুইশূন্য হল চিন!

১৯৬১-৬২। দুর্ভিক্ষ দেখা দিল চিনে। মারা গেল তাদের ৩ কোটি মানুষ। খেত পোকায় ছয়লাপ। ফসল মাঠেই নষ্ট হচ্ছে। দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যুর মিছিলে টনক নড়ল সরকারের। নিরুপায় হয়ে মস্কোর কাছ থেকে চড়ুই ফিরিয়ে আনতে হল!

আমরা যাদের দেখি, তারা আসলে গৃহী চড়ুই। আদি নিবাস নাকি ইউরেশিয়া এবং আফ্রিকা। প্রায় হাজার দশেক বছর ধরে এরা আমাদের পড়শি। আমাদের অনেকেরই ছোটবেলায় কৌতূহল ছিল ঘরের ভিতর খড়কুটো মুখে ধরে উড়ে আসা মা চড়ুই আর তার ক্ষুদে ছানাকে ঘিরে। ওপর থেকে অসাবধানে পড়ে যাওয়া চড়ুই ছানা দেখে অনেকেরই শোক ও বাৎসল্য জাগে। বহু কষ্টে ছানাটিকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পরে অবাক হয়ে দেখতাম, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চড়ুই মা-বাবা মানুষের ঘাঁটাঘাঁটি করা বাচ্চাটাকে বাসায় নেয় না। এ-ও এক আশ্চর্যের ব্যাপার। মানুষের গায়ে গায়ে থাকবে, কিন্তু মানুষের স্পর্শ সইবে না। পোষও মানবে না।

এই মানুষের পড়শিই এখন বিপন্ন। কখনও মোবাইল টাওয়ারের জন্য, কখনও আবার রেস্তোরাঁয় রান্না হয়ে প্লেটে হাজির তারা!

চাইলেই আমরা চড়ুই বাঁচাতে পারি। অন্তত বাঁচাতে যে চাই, তা এই চড়ুই দিবস পালনের মধ্যেই নিহিত। একটি প্রতীকী দিবস মানে পক্ষীকুলের এক প্রান্তিক স্বর শুনতে পাচ্ছি। শুনতে পেলেই কাজটা যে অনেক দূর এগিয়ে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sparrow decreased Endangered
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE