Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

চোদ্দো বছর স্কুল থেকে ছুটি নেননি প্রেমলাল

এক এক করে পার হয়েছে চোদ্দ বছর। একদিনও স্কুল কামাই করেননি প্রেমলাল। রবিবারেও একবার স্কুলে গিয়ে ঢুঁ মেরে আসেন।

নজির: প্রেমলাল সিংহ

নজির: প্রেমলাল সিংহ

অনির্বাণ রায়
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:০৫
Share: Save:

ধুম জ্বরে কাতরানো স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে স্কুলে এসে ছুটির ঘণ্টা বাজিয়েছেন।

‘ছোট কাকু’কে দাহ করেই শ্মশান থেকে ছুট লাগিয়েছেন। স্কুলে এসে গাছে জল দিয়েছেন।

এক এক করে পার হয়েছে চোদ্দ বছর। একদিনও স্কুল কামাই করেননি প্রেমলাল। রবিবারেও একবার স্কুলে গিয়ে ঢুঁ মেরে আসেন।

তিনি বলেন, ‘‘স্কুলে না গেলে মনে হয় দিনটা বুঝি শেষ হবে না।’’ তিনি প্রেমলাল সিংহ। শিলিগুড়ির বিধাননগর মুরলীগঞ্জ স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির স্থায়ী কর্মী। তাঁর সার্ভিসবুকে লেখা রয়েছে কাজে যোগদান ২০০৪ সালের নভেম্বর। এতদিন পর্যন্ত নেওয়া ছুটির সংখ্যার পাশে লেখা শূন্য। চোদ্দ বছরে একদিনও ছুটি নেননি প্রেমলাল। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সামসুল আলমের কথায়, ‘‘প্রেমলাল আমাদের গর্ব। কর্মসংস্কৃতির এক অনন্য নজির। বলতে গেলে প্রেমলালকে দেখে আমি বা আমার সহকর্মীরাও নিতান্ত বাধ্য হলেও ছুটি নিই না।’’

কেন ছুটি নেন না প্রেমলাল? মাধ্যমিকে দ্বিতীয় ডিভিশনে পাশ করেছিলেন তিনি। এক সময় সংসার চালাতে জন্য ট্রাকে পণ্য ওঠানো নামানোর কাজ করতেন। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের চিঠি পেয়ে বিধাননগরের স্কুলে চাকরি পেয়েছিলেন। প্রেমলাল বলেন, ‘‘স্কুলে কাজ শুরু করার পরেই মনটা বদলে গেল। স্কুলের ফুলবাগান, চেয়ারটেবিল, ছাত্র-ছাত্রীদের দেখলেই একটা অনুরপ্রেরণা পেতাম।’’ নিজের তিন ছেলেকেও এই স্কুলে পড়িয়েছেন তিনি। প্রেমলাল বলে চলেন, ‘‘নিজে স্কুলজীবনে ভাল ছাত্র ছিলাম না। আমি না গেলে কোনও ভাবে স্কুল চালানোর ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়বে। তা চাই না।’’

মাস ছয়েক আগের কথা। স্ত্রী মনা-র দু’দিন ধরে জ্বর। কোন ওষুধ কখন খাওয়াতে হবে বড় ছেলেকে বুঝিয়ে স্কুল করেছেন প্রেমলাল। তিনদিনের দিন জ্বর মাত্রা ছাড়াল। প্রেমলালের কথায়, ‘‘মনার জ্বর এত বাড়ল যে কথা বলাও বন্ধ হয়ে গেল। ভ্যানে চাপিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম মনাকে।’’ হাসপাতালে স্ত্রীকে ভর্তি করে পরিচত একজনের সাইকেল জোগাড় করে চার কিলোমিটার চালিয়ে সোজা স্কুলে। স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন নিজে রাতভর হাসপাতালে থাকতেন। ছেলেরা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সামলে দিত। প্রেমলালের কথায়, ‘‘সে সময়ও একদিনও স্কুল বাদ দিইনি।।’’

মাসখানেক আগের একটি ঘটনাও শোনালেন প্রেমলাল। এক আত্মীয়ের মৃত্যু হয়েছে। প্রেমলাল জানালেন, ‘‘শ্মশানে যখন পৌঁছলাম ততক্ষণে স্কুলের সময় হতে চলেছিল। অনেকে ছুটি নিতে বলেছিলেন। ভাবলাম আমি ছুটি নিয়ে শ্মশানে থাকলে শোক এতটুকু কমবে না, উল্টে স্কুলের কাজে কিছু সমস্যা হতে পারে। তাই চলে গেলাম স্কুলে।’’

একদিন দাঁতে ব্যথা সহ্য করতে না পেরে স্কুলের ঘরেই শুয়ে পড়েছিলেন। খবর পেয়ে প্রধানশিক্ষক আসায় জোড়হাতে অনুরোধ করেছিলেন, ‘‘স্যার, আমি ছুটি চাই না। একটু ওষুধ আনার ব্যবস্থা করে দিন। তাহলেই সেরে যাবে।’’ এক শিক্ষক ছুটে গিয়ে ওষুধ নিয়ে এসেছিলেন।

সে দিনও স্কুল কামাই হয়নি প্রেমলালের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE