উল্লাস: স্কুলের পথে প্রতিমা। হুল্লোড় বার্লো স্কুলের ছাত্রীদের। নিজস্ব চিত্র
সুনীতিবালা সদর উচ্চ বালিকা: জলপাইগুড়িতে নারী শিক্ষার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। সময়টা ১৯২৫। কলকাতা থেকে জলপাইগুড়িতে এসে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রী সংগ্রহ করতেন। জেলার প্রথম রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সরস্বতী’ সম্মান লাভ করেন। জলপাইগুড়ি শহরে ১৮৭১ সালে তাঁর উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় সদর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। তিনি, শহরবাসীর কাছে সদর গার্লস নামে পরিচিত ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সুনীতিবালা চন্দ ছাত্রী ও শিক্ষিকা মহলে পরিচিত ছিলেন ‘বড়দিমণি’ নামেই। পরে তাঁর অবদান স্মরণীয় করে রাখতেই স্কুলের নাম হয় সুনীতিবালা সদর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।
বড়দিমণি ব্রাহ্ম ছিলেন না, কিন্তু ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাঁর আমলে ফি বছর মাঘোৎসবের উপাসনায় যোগ দিতেন ছাত্রীরা। ১১ মাঘ ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা দিবসে স্কুল ছুটি থাকত। ‘কথামৃত’ থেকেও পাঠ করে শোনাতেন তিনি। মেয়েরা শিবরাত্রি পালনেরও সুযোগ পেত। ব্রাহ্ম ও খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত শিক্ষিকারাও ছিলেন। পড়ুয়াদের মধ্যে ছিলেন বনেদি ঘরের মুসলমান মেয়েরাও। স্কুলে সব সময়ে জেগে থাকত উদার সম্প্রীতির এক পরিবেশ।
প্রাক স্বাধীনতা আমলে সরস্বতী পুজোকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হতো মেয়েদের হাতে লেখা পত্রিকা—‘জাগরণ’। এখন আর পুজো সংখ্যা প্রকাশিত হয় না। স্কুল পত্রিকার নাম হয়েছে ‘জাগরণ’। সেই আমলের এক প্রাক্তনী মিন্টু লাহিড়ীর লেখনী বলছে, ‘‘সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেল কাগজ কেটে নিজে হাতে আল্পনা দিয়ে সাজিয়েছি। সবাই মিলে প্রতিমা সাজানোর মধ্যে সকলের একটা ঐক্যবোধ ও আন্তরিকতা গড়ে উঠত।’’ স্কুলে যারা ভাল গাইতে পারত এমন এক-দু’জন সন্ধেয় গানও গাইত। স্কুলের প্রাক্তনী এবং এই স্কুলেরই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা অদিতি হালদার জানালেন, মণ্ডপ সাজাতে বাইরে থেকে ডেকরেটার্সের লোক আসতেন না। শিক্ষাকর্মীদের হাতেই তৈরি হতো মণ্ডপ। ‘‘আমরা কাগজ কেটে মালা তৈরি করে, ফুল, প্রদীপ, রঙিন ঘট দিয়ে মণ্ডপ সাজাতাম’’, জানালেন আরেক প্রাক্তনী রত্না সেন রায়। এ বছরও শিক্ষিকাদের তত্ত্বাবধানে ছাত্রীরা পুজোর কাজ করবে। প্রকাশিত হবে ছাত্রীদের লেখা দেওয়াল পত্রিকা, জানালেন প্রধান শিক্ষিকা অপর্ণা বাগচি।
কোচবিহার সদর গভর্নমেন্ট: পুজো থেকে প্রসাদ বিতরণ সব কিছু শেষ করতে হতো দিনের আলো থাকতে থাকতেই। তখনও বিদ্যুৎ ছিল না, ছিল না হ্যাজাকও। রাতে সরস্বতীর সামনে জ্বলত তেলের প্রদীপ। ১৮৩১ সাল। স্থাপিত হল কোচবিহার সদর গভর্নমেন্ট স্কুল। ছাত্র সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। তাদের আর্থিক অবস্থাও ভাল ছিল না। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্র জোগাড় করতে হতো। পুজোর সামগ্রী থেকে প্রসাদ বিতরণ সবটাই চলত কোচবিহার মহারাজাদের আর্থিক অনুদানে। স্কুল প্রাঙ্গণে ছাত্ররা বাঁশ ও খড় দিয়ে মন্ডপ তৈরি করত। পুজোর দিন ধুতি পরে আসত ছাত্ররা।
পঞ্চাশের দশক থেকে ছবিটা বদলে যায়। পাজামা-পাঞ্জাবি, প্যান্ট-শার্ট পরার রীতি চালু হল। পরে অবিভক্ত বঙ্গদেশের ময়মনসিংহ, রঙপুর, বগুড়া বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্ররা পড়তে আসা শুরু করল। ১৯৫০ পর্যন্ত কোচবিহার মহারাজারা পুজোর ব্যয়ভার বহন করতেন। তখন স্কুলটি ছিল অবৈতনিক। তার পর ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন নেওয়া চালু হল। তখন থেকেই পুজো উপলক্ষে ছাত্রদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার রেওয়াজ চালু হল। ১৮৭ বছরের সময়ের স্রোতে বদলে গেছে পুজোর ছবিটি। আয়োজিত হয় সান্ধ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মঞ্চস্থ হয় নাটক, থাকে প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস বিষয়ক প্রদর্শনী। জানালেন প্রধান শিক্ষক মলয়কান্তি রায়।
বার্লো বালিকা: সকাল ছ’টার মধ্যেই স্কুলে হাজির হয়ে পুজোর কাজে হাত লাগায় নবম, দশম ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রীরা। ও দিকে পুজোর ভোগ রাঁধতে থাকেন শিক্ষিকারাই, জানালেন বিদ্যালয়ের প্রাক্তনী ও বর্তমানে প্রধান শিক্ষিকা দীপশ্রী মজুমদার। দেড়শো বছর ছুঁই ছুঁই মালদহের বার্লো উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের এই প্রাক্তনীর কথায়, ‘‘আমরা যখন পড়তাম তখন এত আলো, সাজসজ্জা, চাকচিক্য ছিল না। প্রসাদ বলতে ছিল মিষ্টির প্যাকেট। কখনও কখনও লুচি ও বোঁদে।’’ গত বছর ছিল ছাত্রীদের হাতের কাজের প্রদর্শনী, এ বছর থাকছে আল্পনা প্রতিযোগিতা। ১৮৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলে থিমের জোয়ার এল ২০১৬ সালে। এ বার চটের ওপর ওরলি পেন্টিং দিয়ে তৈরি হবে গ্রাম্য পরিবেশ। (শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy