Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

উত্তরের কড়চা

বালুরঘাটের বিমানঘাঁটির অদূরের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় ‘দুধরাজ’। আলিপুরদুয়ারের রাস্তার ধারের ক্যামেলিয়া গাছে সিপাই বুলবুল সংসার পেতেছে। কোচবিহারের নিশিগঞ্জের পাখিপ্রেমীর বাড়িতে তেজপাতা গাছ বেয়ে উঠে সুপারি গাছের বাসা থেকে টিয়াপাখি চুরি করে নিয়েছে চোরেরা।

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৫ ০২:২৩
Share: Save:

পালকের উড়ান

বালুরঘাটের বিমানঘাঁটির অদূরের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় ‘দুধরাজ’। আলিপুরদুয়ারের রাস্তার ধারের ক্যামেলিয়া গাছে সিপাই বুলবুল সংসার পেতেছে। কোচবিহারের নিশিগঞ্জের পাখিপ্রেমীর বাড়িতে তেজপাতা গাছ বেয়ে উঠে সুপারি গাছের বাসা থেকে টিয়াপাখি চুরি করে নিয়েছে চোরেরা। শসা-তরমুজ-পটল খেতের মধ্যে ভরত পাখির ওড়াওড়ি। এমন জরুরি সব সংবাদ পেতে হলে হাতে নিতে হবে ‘পালক’। নামের মতোই হালকা কিন্তু বড় মনোরম একটি ছোট্ট পত্রিকা। যা শুধু পাখিদের নিয়ে, তবে মানুষের জন্য। আলিপুরদুয়ার থেকে প্রকাশিত হচ্ছে পালক’। প্রধান সম্পাদক জীবনকৃষ্ণ রায় পাখিমহলে পরিচিত ‘জেকে’ নামেই। শেখর সরকার, শিবুন ভৌমিকের সঙ্গে সামিল হয়েছেন রাজ্যের নানা প্রান্তের পরিচিত সব পাখিপ্রেমী। পরিবেশ বা বন্যপ্রাণ নিয়ে সারা দেশ থেকে বহু ছোট পত্রিকা প্রকাশিত হলেও, কেবল পাখিদের নিয়ে একটা আস্ত কাগজ ক’টাই বা আছে? দু’বছরে পড়তে-চলা ‘পালক’ পত্রিকার জগতে তাই আলাদা একটা জায়গা করে নিয়েছে। আলিপুরদুয়ার থেকে প্রকাশিত পত্রিকাটির দাম ১০ টাকা। শ্রীলঙ্কার জাতীয় পাখি যে বনমুরগি, এক রকম হাঁস যে গাছেও বাসা বাঁধে, কিংবা ২০ মার্চ যে আন্তর্জাতিক চড়ুই দিবস, এমন সব দরকারি কথা অজানা থেকে যেত এই কাগজ হাতে না এলে।

মুক্তির মন্দির

বীর হনুমান, তাই তাঁকে পুজো করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। ১৯৪২ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার বাসিন্দাদের অনেকে রায়গঞ্জের রেলস্টেশন লাগোয়া এলাকায় হনুমান মন্দির তৈরি করেন। মন্দিরের দেওয়াল খোদাই করে পাথরের অর্ধাবয়ব হনুমান মুর্তি তৈরি করা হয়। এলাকার বাসিন্দারা বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নামার আগে দেশের ও নিজেদের মঙ্গল কামনা করে ওই মন্দিরে পুজো দিতেন। ইংরেজদের দেশ থেকে হটিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা সংগ্রামীরা শেষবারের মতো ওই মন্দিরে পুজো দেন। এরপর মন্দিরটির দায়িত্ব তাঁরা স্টেশনের তৎকালীন কুলিদের হাতে তুলে দেন! সেই থেকে আজও বিহারের বাসিন্দা কুলিদের একাংশ ও তাঁদের পরিবারের লোকজন ওই মন্দিরে দুবেলা পুজো করে আসছেন। প্রতি বছর নিয়ম করে মন্দিরটির ছোটখাটো মেরামতির কাজ করান তাঁরা। কিন্তু ক্রমশ মন্দিরটি জীর্ণ হয়ে পড়েছে। সিমেন্টের তৈরি ওই মন্দিরের দেওয়ালে অসংখ্য ফাটল ধরেছে। বাসিন্দাদের দাবি, অবিলম্বে সরকারি উদ্যোগে মন্দিরটির সংস্কার করতে হবে। যে কোনও সময়ে সেটির অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। রেলমন্ত্রকের সরকারি জমিতে মন্দিরটি রয়েছে। সকলেই চাইছেন হেরিটেজ কমিশন মন্দিরটি অধিগ্রহণ করুক।

অনুপম জলাধার

জলের ট্যাঙ্কও কি হতে পারে ঐতিহ্যের স্মারক? পারে বইকী, যদি তা হয় রাজ আমলের নিদর্শন। কোচবিহারের পাওয়ার হাউস মোড়ের জলের ট্যাঙ্কটি এখন সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, সেই সময় জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ নাবালক, ক্ষমতায় ছিলেন প্রয়াত মহারাজা জীতেন্দ্র নারায়ণের স্ত্রী ইন্দিরা দেবী। শহরে রাজবাড়ি ধরে প্রতিদিন দেড় লক্ষ গ্যালন জলের চাহিদা ছিল। নরেন্দ্র নারায়ণ পার্কের পশ্চিমে ৬০ হাজার গ্যালন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ৮৫ ফুট টাওয়ার তৈরির পরিকল্পনা করা হয়, সঙ্গে ৫০টি লোহার অটোমেটিক স্ট্যান্ড পোস্ট বসানো হবে ঠিক হয়। সে যুগে খরচ ধরা হয় আনুমানিক ২ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা। স্কটল্যান্ডের একটি কোম্পানি জলের পাইপলাইন-সহ লোহার কলের জোগান দেয়। বর্তমানে রাজ আমলের ওই নির্দশনের বেহাল দশা। কোচবিহার হেরিটেজ সোসাইটির সম্পাদক অরূপজ্যোতি মজুমদার বলেন, অনুপম স্থাপত্যের নির্দশন ওই জলের টাওয়ার রাজ আমলের স্মারক হিসেবে পুরোপুরি সংস্কার করা দরকার। পর্যটনের স্বার্থে তার সামনে থেকে জবরদখল ঊচ্ছেদ করে সৌন্দর্যায়নও করতে হবে।

মাশান শিল্পী

নীহারের খোঁজে অন্তত ১৬ রকমের অপদেবতা রয়েছে। কেউ কালাজ্বরের, কেউ কলেরার। পেটের রোগের অপদেবতার সঙ্গে জ্বরের অপদেবতার মিল নেই। এই সমস্ত অপদেবতাদের সম্পর্ক নানা তথ্য এবং ছবি নিয়ে তৈরি হয়েছে তথ্যচিত্র। ‘মাশান অন ক্যানভাস এন্ড ওয়ার্ক’ নামে ৩২ মিনিটের এই তথ্যচিত্রটি তৈরি হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের ইস্টার্ন জোনাল কালচারাল সেন্টারের উদ্যোগে। অশোক বিশ্বনাথন পরিচালিত এই তথ্যচিত্রের গবেষণা এবং পরিকল্পনা নীহারের। মাশান হল অপদেবতাদের পোশাকি নাম। কেউ কলেরার মাশান, কেউ বা কালাজ্বরের। মাশানের নানা ছবি সহ এই শিল্পের উৎস জানা যাবে তথ্যচিত্রে। জলপাইগুড়ির সেনপাড়ার কালীতলা রোডের বাসিন্দা পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই নীহার মজুমদারের আঁকার স্কুল রয়েছে। সব রকমের ছবিতে নীহারের তুলি সচ্ছন্দ হলেও, মাশান-শিল্পকেই নিজের ঘরানা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তিনি। রাজবংশীদের অপদেবতার সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করতে টানা ১৯ বছর তাঁকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরতে হয়েছে বলে নীহার জানিয়েছেন। মাশানের ছবির রঙচঙে ধরন ও তিব্বতি শিল্পের ছোঁয়া তাঁকে আকৃষ্ট করে। সেই মতো মাশান ফর্মে আঁকা শুরু করেন তিনি। তাঁর আঁকা মাশানের ছবির প্রদর্শনী অস্ট্রেলিয়া, হংকং, জার্মান, ফ্রান্স এবং ইতালিতে হয়েছে। নীহারের দাবি, রং-তুলির মাধ্যমেই অপদেবতার তকমা থেকে আধুনিক আর্টফর্মে মাশানের উত্তরণ। সেই উত্তরণকে মর্যাদা দিতেই তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে। জানা যায়, এক সময়ে চালু থাকা সিল্করুট ধরেই মাশানের উত্তরবঙ্গ প্রবেশ। বৌদ্ধধর্ম অনুসারীদের হাতে তৈরি ‘থাঙ্কা’ শিল্প থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে মাশানের জন্ম বলে মনে করা হয়।

বিরল মিলন

গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মহানন্দা। নদীর পাড়ে মনসা মন্দির। তার থেকে ৫০ ফুট দূরে মসজিদ। শতাধিক বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী মনসা মেলার জন্যই জেলায় পরিচিতি রয়েছে মালদহের চাঁচলের বলরামপুর গ্রামের। ওই মনসা মেলাকে অনেকেই সম্প্রীতির মেলাও বলে থাকেন। কারণ মন্দিরের আরতি বা মসজিদের আজান কারও কাছেই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনও। এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়, ব্রিটিশ শাসকরাও গ্রামে মুখোমুখি মন্দির আর মসজিদ দেখে তার প্রশংসা করেছিলেন। গ্রামের উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ বলেন, মুখোমুখি মন্দির আর মসজিদ বরং আমাদের একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা বাড়িয়েছে। সেটা যে বাসিন্দাদের মুখের কথা নয়, তা মনসা মেলায় বা মহরম উৎসবে হাজির হলেই বোঝা যায়। দুই সম্প্রদায়ের মানুষ হইহই করে আনন্দ করেন। মুখে ভাতের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বিয়ে, এমনকী মৃত্যুর পরে অন্তিম যাত্রাতেও সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকেন একে অন্যের পাশে। নদী ভাঙন এলাকার এক মস্ত সমস্যা। কোন বাড়ি কাওসার আহমেদের, আর কোনটা রিপন মন্ডলের, সেই বিভেদ নদী তো মানে না। তাই ভাঙন রোধের লড়াইয়েও একে অন্যের সামিল তারা। গ্রামের বাসিন্দা মহম্মদ আলি জিন্না, রাজকুমার মন্ডলরা বলেন, শৈশবেই অভিভাবকরা একসঙ্গে থাকার আনন্দের কথা আমাদের কানে মন্ত্রপাঠের মতো পড়িয়ে দেন! পরম্পরায় ওই মন্ত্র নিয়েই আমরা আনন্দে বাঁচি।

পুতুল নেবে গো

পুতুল সাজা ওঁদের নেশা। পুজো পার্বণ বা কোনও অনুষ্ঠানে ডাক পেলে গায়ে-মুখে রঙ মেখে নিজেদের অবিকল মাটির পুতুলের মত তৈরি করে ফেলেন। তারপর তাঁদের জন্য তৈরি-করা মঞ্চে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে ‘স্ট্যাচু’ হয়ে থাকেন। দাম না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আলুচাষির আত্মহত্যা, বা মোবাইল ফোনে টোপ দিয়ে প্রেম, ও তারপর বিয়ের প্রলোভনে নারী পাচারের মত ঘটনাগুলিকে পুতুল সেজে তুলে ধরেন কোচবিহার জেলার মাথাভাঙার দেওয়ানবস গ্রামের বাসিন্দারা। তাদের সকলে কৃষক। দু’জন মহিলা শিল্পীও রয়েছেন দলটিতে। ১৫ বছর আগে অমল বর্মন ও তাঁর ভাই প্রথমবার গ্রামের মণ্ডপে পুতুল সাজেন। পরে অন্যরাও তালিম নেন। পুতুল সাজা নেশা হয়ে দাঁড়ায় বাকিদের কাছে। কমলের কথায়, পুতুল সেজে দুঃখ যতটা পেয়েছি, আনন্দ পেয়েছি তার বেশি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

uttar korcha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE