Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

উত্তরের কড়চা

জলপাইগুড়ি ও রানীনগরের মাঝে রেলের একটি হল্ট স্টেশন মোহিতনগর। কিন্তু কেউ যদি মঙ্গলা, সুমঙ্গলা বা শ্রীমঙ্গলার সঙ্গে মোহিতনগরের সম্পর্ক খু্ঁজতে চান তা হলে সেটা সুকুমার রায়-এর ‘হযবরল’র মত হয়ে যাবে না কি! কিন্তু না, এদের মধ্যে সম্পর্ক একটা রয়েছে।

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

মোহিতনগরে সুপারির পাশে এ বার নারকেলও

জলপাইগুড়ি ও রানীনগরের মাঝে রেলের একটি হল্ট স্টেশন মোহিতনগর। কিন্তু কেউ যদি মঙ্গলা, সুমঙ্গলা বা শ্রীমঙ্গলার সঙ্গে মোহিতনগরের সম্পর্ক খু্ঁজতে চান তা হলে সেটা সুকুমার রায়-এর ‘হযবরল’র মত হয়ে যাবে না কি! কিন্তু না, এদের মধ্যে সম্পর্ক একটা রয়েছে। এগুলো সবই সুপারির বিভিন্ন রকম প্রজাতির নাম। প্রায় দুই হাজার বছর ধরে ভারতবাসীর প্রাত্যহিক জীবনে, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুপারি। এশিয়ার নানা দেশ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহেও সুপারির বহুল ব্যবহার আছে। শুধুমাত্র ভারতেই নাকি প্রতি বছর প্রায় ৫.৫৯ লক্ষ টন সুপারি উত্‌পন্ন হয়। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোপণ ফসল। এদেশে মূলত কর্নাটক আসাম কেরালা মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুতে সুপারির চাষ বেশি হয়। তবে উত্তরবাংলায়ও সুপারি ভাল হয়। সে কারণেই হয়তো মোহিতনগরে গড়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় রোপণ ফসল অনুসন্ধান সংস্থা গবেষণা কেন্দ্র। ১৯৫৮ সাল থেকে ক্ষেত্রীয় সুপারি অনুসন্ধান কেন্দ্র হিসেবে এই কেন্দ্র কাজ করে চলেছে। ১৯৭০ সাল থেকে এই কেন্দ্র ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদের অধীন কেন্দ্রীয় সুপারি অনুসন্ধান সংস্থা, কাসরগড়, কেরলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করছে। ১৯৯৩ সালে এই কেন্দ্র কালচিনির সুপারির উপর গবেষণা করে অধিক ফলনশীল একটি নতুন সুপারি প্রজাতি প্রকাশ করে। যার নামকরণ করা হয় ‘মোহিতনগর’। এর ফলন ক্ষমতা বছরে গাছ প্রতি ৩.৭ কেজি. শুকনো সুপারি। যা অন্যান্য প্রজাতির তুলনায় বেশ খানিকটা বেশি।

এটি ভারতের প্রায় সব সুপারি উত্‌পাদন অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত।
হিমালয় সংলগ্ন তরাই অঞ্চলের জন্য বেশি লাভদায়ক। সুপারিভিত্তিক মিশ্র চাষ পদ্ধতিও নির্দিষ্ট করেছে এই কেন্দ্র। যা কৃষকদের দ্বিগুণ লাভ পেতে সাহায্য করে। কেন্দ্রের বিজ্ঞানী অরুণ কুমার সিট জানান, এ বছর কেজি প্রতি কাঁচা সুপারির দাম যাচ্ছে ৪৯ টাকা। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে এই দাম ১৬ টাকা থেকে ১৮টাকাও গিয়েছে। সাধারণত ক্ষুদ্র চাষিরাই এই চাষ করেন। দামের অনিশ্চয়তার জন্য অনেক সময় উপার্জনের দিক থেকে তারা পিছিয়ে পড়েন। ভাল বিৃ্দ্ধ ও ফলনের জন্য সাধারণত জমির ৩০ শতাংশ ব্যবহার হয়। গাছের পাতা ভেদ করে ৪৫ শতাংশ সূর্যের আলো মাটিতে পড়ে। এই ৭০ শতাংশ জমি ও ৪৫ শতাংশ সূর্যালোক ব্যবহার করে অন্যান্য ফসল ফলানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কেন্দ্রের ৮ হাজার সুপারি গাছযুক্ত ৯ হেক্টর জমিতে মিশ্র ফসল হিসেবে চাষ করা হচ্ছে। গোলমরিচ, দারচিনি, হলুদ, আদা, ওল, কলা, লেবু, কফি, কোকো, আনারস বিভিন্ন রকমের পাতা-সবজি ও ফুল। প্রতি বছর গাছ প্রতি ১-১.৫ কেজি শুকনো গোলমরিচ পাওয়া যায়। সুপারি জাত দ্রব্য হিসেবে পাতার গোড়ার দিকের চওড়া অংশ থেকে এই কেন্দ্রে তৈরী হচ্ছে অনুষ্ঠানবাড়ির জন্য বিভিন্ন আকার ও আকৃতির থালা-বাটি-প্লেট। যা একই সঙ্গে পরিবেশ বান্ধব, স্বাস্থ্যসম্মত আর অভিনব। বর্তমানে এখানে নারকেলের ওপরও গবেষণা চলছে। ইতিমধ্যে মূল্যায়নের জন্য ৭০ রকমের নারকেল গাছ রোপণ করা হয়েছে। সারা দেশের সুপারি ক্ষেতগুলোতে মোহিতনগর সুপারির এখন যেমন কদর, নারকেলের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হবে বলে আশা করা যেতেই পারে।

—নিজস্ব চিত্র।

কল্পদীপ উত্‌সব

সম্প্রতি জলপাইগুড়ি শহরের ‘কল্পদীপ’ নাট্যসংস্থার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হল দ্বিতীয় কল্পদীপ উত্‌সব। ধ্রুপদী সঙ্গীত ও নৃত্য ছিল উত্‌সবের অন্যতম আকর্ষণ। প্রদীপ প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন সাংসদ বিজয়চন্দ্র বর্মন। সংস্থার ছাত্ররা পরিবেশন করেন ওড়িশি নৃত্য শিবস্তুতি-আনন্দ তাণ্ডব। স্বপনকুমার দাসের চর্চিত ও রেওয়াজি সেতার বাদন দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখে। পৌষালি মুখোপাধ্যায়ের মঙ্গলাচরণ, সরস্বতী বন্দনা, পরে অষ্টপদীতে সেজে ওঠা জয়দেবের গীতগোবিন্দ মন কাড়ে। সংস্থার কর্ণধার পম্পি পাল ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা নিবেদন করেন ওড়িশি নৃত্য আঙ্গিকে ভানুসিংহের পদাবলি। উত্‌সবের দ্বিতীয় দিনে বসেছিল আলোচনার আসর। ‘গুরুশিষ্য পরম্পরা’ নিয়ে বলেন পৌষালি মুখোপাধ্যায়। ওড়িশি নৃত্যের তাল ও বাদ্যযন্ত্র মর্দালা নিয়ে বলেন সচ্চিদানন্দ দাস। অসীমবন্ধু ভট্টাচার্যের কথায় ধরা পড়ে কত্থক নৃত্যের আধুনিকতা ও তার প্রভাব। ওড়িশি নৃত্য ও নৃত্যে ব্যবহৃত সঙ্গীতের নানান কথা শোনা যায় সঙ্গীতা গোঁসাইয়ের আলোচনায়। হিন্দুস্থানি কর্নাটকি, ওড়িশি কণ্ঠসঙ্গীতের তফাত ও সাযুজ্য তুলে ধরেন তিনি। সান্ধ্য অনুষ্ঠান শুরু হয় কল্পদীপের ছাত্রছাত্রীদের মঙ্গলাচরণ দিয়ে। ওড়িশি কণ্ঠসঙ্গীত ও মর্দালার যুগলবন্দি নিবেদন করেন সঙ্গীতা গোঁসাই ও সচ্চিদানন্দ দাস। পম্পি পালের ওড়িশি নৃত্য বাহবা আদায় করে নেয়। সবশেষে মঞ্চে উপাসনা সেন্টার অব ডান্স-এর পরিবেশনা কত্থক নৃত্য আঙ্গিকে তৈরি ‘ঘুঙরু’।

চতুর্ভুজা সিংহবাহিনী

দেবী এখানে চতুর্ভুজা সিংহবাহিনী। ষষ্ঠীর ১২ দিন আগে কৃষ্ণানবমী তিথি থেকে ওই মণ্ডপে পুজো শুরু হয়ে যায়। প্রথা মেনে সপ্তমীর ভোরে চাঁচল রাজবাড়ি লাগোয়া ঠাকুরবাড়ি থেকে ওই প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয় পাহাড়পুরে। ঢাক-ঢোল সহকারে শোভাযাত্রা করে ওই প্রতিমা নিয়ে এসে বসানো হয় মাটির প্রতিমার পাশে। বিসর্জনের দিন ৩০০ বছরের রীতি মেনেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা হ্যারিকেনের আলো জ্বেলে দেবীকে বিদায় জানান। রাজবাড়ির পুজো বলে প্রত্যেকেরই আলাদা আবেগ রয়েছে পুজোকে ঘিরে। এলাকার সাধারণ মানুষ গভীর ভাবে বিশ্বাস করেন য়ে পাহাড়পুর চণ্ডীমণ্ডপের দেবী তাদের সুরক্ষিত রেখেছেন। চণ্ডীমণ্ডপকে ঘিরে বাসিন্দাদের আবেগের কথা অজানা নয় ট্রাস্টি বোর্ডের। কিন্তু অর্থাভাবে সংস্কার করা যাচ্ছে না বলে দাবি। এই অবস্থায় প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে বাসিন্দারা। কারণ, মালদহের চাঁচলের পাহাড়পুরের চণ্ডীমণ্ডপের রং উঠে গিয়েছে। খসে পড়ছে পলেস্তারা। রাজা নেই। বিক্রি হয়ে গিয়েছে রাজবাড়িও। একাংশে কলেজ। বাকি অংশে মহকুমা আদালত। চাঁচলে রাজ পরিবারের পরিচয় বহন করে চলেছে পাহাড়পুরের চণ্ডীমণ্ডপটি। ট্রাস্টি বোর্ড পুজোর পরিচালনা করে। বাজেট ৭ হাজার টাকা। স্বভাবতই জাঁক বা আড়ম্বরের বালাই থাকে না। তবু ৩০০ বছরের পুরনো নিষ্ঠা, ভক্তি, ঐতিহ্যের ওই পুজোর আকর্ষণই আলাদা।

অন্য রকম পরিবেশ

শহরের কাছে হলেও পরিবেশটা অন্যরকম। একদিকে চা বাগান। অদূরে পাহাড়ের হাতছানি। খুব কাছ দিয়েই বয়ে চলেছে পঞ্চনই। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিঙের রাস্তায় দাগাপুরে জ্ঞানজ্যোতি কলেজের পরিবেশ পাঁচটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের থেকে কিছুটা আলাদা। শহরের বাইরে তা শুরু করে বিবেকানন্দ অ্যাকাডেমিক ফাউন্ডেশন। দেখতে দেখতে ১০ বছরে পড়ল কলেজটি। গত ৮ অগস্ট কলেজের প্রতিষ্ঠা দিবসে হল এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সোমনাথ ঘোষ প্রধান অতিথি। মাস কমিউনিকেশনে ছাত্র অভিষেক পালের শ্লোক আবৃত্তি দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু। রবীন্দ্রনাথের মূর্তিতে মালা দিয়ে, প্রদীপ জ্বালানো হয়। ভাষণ দেন অধ্যক্ষ শম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরস্বতী বন্দনার পরে ফাউন্ডেশনের সভাপতি জিএস হোরা বক্তৃতা দেন। ম্যাগাজিনের নতুন সংখ্যার উদ্বোধন করেন সহ সভাপতি সুজিত রাহা।

১৮৯তম জন্মজয়ন্তী পালন

কালিম্পং মহকুমার পোলংদঙে লেপচা উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে পালিত হল লেপচা ভাষার ব্যাকরণ ও অভিধান প্রণেতা জেনারেল জি বি মেইনওয়ারিং-এর ১৮৯তম জন্মজয়ন্তী। অতিথিদের খাদা পরিয়ে স্বাগত জানানোর পর লেপচাদের ঐতিহ্য ও রীতি মেনে, বাঁশের প্রদীপ ‘ছামি’ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠান সূচনা হয়। পরিবেশিত হয় লেপচাদের লোকনৃত্যগীত। প্রকাশিত হয় জি বি মেইনওয়ারিং সম্পর্কিত একটি গ্রন্থ। আলোচনা চক্রের মুখ্য বক্তা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভারতীয় ভাষার অধ্যাপক প্রকাশ পট্টনায়ক। প্রবন্ধ পাঠ করেন রত্নোত্তমা দাস, সালডং লেপচা, ডি সি রায়, অভীক মজুমদার, বি বি লেপচা প্রমুখ। ছিলেন সমাজসেবী ডেনিস লেপচা, অধ্যাপক দীপক রায়, পদ্মশ্রী সোনম শেরিং লেপচা।

শিবানী দেবীর সংসার

জলপাইগুড়ির পুর এলাকা ছাড়িয়ে সানুপাড়া। সেই সানুপাড়ার ভাঙাচোরা একটা ঘর। সেখানে বাস করেন শিবানী মণ্ডল। কারও উঠোন ঝাঁট দেওয়া, কারও বাড়ির ফুলগাছে জল দেওয়া, এ সব করে মাসে রোজগার খুব বেশি হলে শ’পাঁচেক টাকা। সেই টাকায় শিবানী চাল কেনেন। প্রতিদিন রান্না হয় এক কেজি চালের ভাত। নিজে খুব সামান্যই খান। বাকিটা গরু-কুকুর-বিড়ালদের খাওয়ান। প্রতিদিন তাঁর অন্নে প্রতিপালিত হয় পঁচিশটির মতো প্রাণী। কেউই কিন্তু তাঁর পোষা নয়, সবারই বাসস্থান রাস্তা। ঘুরে ঘুরে রোজ দু’বেলা এই অবলা প্রাণীগুলির মুখে খাদ্য তুলে দেন তিনি। কিন্তু রাস্তার উপর নয়, রাস্তায় কাগজ বা প্লাস্টিকের টুকরোর উপর খাবার দেন। নিজের পোষ্য বলতে একটি গরু। কেউ দিয়েছিল তাঁকে। সেই গরু দুধ দেয় না। শিবানী দেবীর জীবনে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই দারিদ্রে মোড়া। কিন্তু পোষ্যটিকে বিক্রি করার কথা কখনও স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। কারণ? “কী হবে বিক্রি করে। তার চেয়ে আমার কাছেই থাক।” এ বছর জুন মাসে বিডিও অফিসে বিধবা ভাতার জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু এখনও কোনও সুরাহা হয়নি। এত দারিদ্র তবুও এই কাজ করেন কেন, জানতে চাইলে শিবানীদেবীর পাল্টা প্রশ্ন, “মানুষে মানুষে এত হিংসা কেন? বিবেকানন্দ বলেছেন, জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর, হয়তো এই জন্যই করি।” শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক। বন্যায় সেই স্বীকৃতির প্রমাণপত্রও হারিয়ে গিয়েছে। অবোধ প্রাণীগুলির কষ্ট অনুভব করেন যিনি, তাঁর কষ্ট অনুভব করার জন্য কেউ থাকতে পারে না? রক্তসম্পর্কের আত্মীয় কেউ নাই বা থাকল, শিবানীদেবীর পাশে থাকতে পারত না কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

uttar karcha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE