Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

উত্তরের কড়চা

চা-বিলাস বলতে শৌখিন বাঙালি এতদিন বুঝেছে ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’, ফিনফিনে পেয়ালাপিরিচ, বাহারি টিকোজি, ছোট্ট ছাঁকনি। যাঁরা খুঁতখুঁতে, তাঁরা জলের টেম্পারেচার নিয়েও বেজায় সচেতন। কিন্তু ক্রমশ আর এক রকম চা বিলাস শিখছে সমতলের বাঙালি।

শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৭
Share: Save:

মায়া-রাজ্যে পর্যটন

চলো চা বাগিচায়

চা-বিলাস বলতে শৌখিন বাঙালি এতদিন বুঝেছে ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’, ফিনফিনে পেয়ালাপিরিচ, বাহারি টিকোজি, ছোট্ট ছাঁকনি। যাঁরা খুঁতখুঁতে, তাঁরা জলের টেম্পারেচার নিয়েও বেজায় সচেতন। কিন্তু ক্রমশ আর এক রকম চা বিলাস শিখছে সমতলের বাঙালি। তা হল, চা বাগানে পর্যটন। এতদিন হাতে-গুনে গুটিকতক বাগিচায় সে সুবিধে ছিল। এ বার তা ক্রমশ আসছে মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে। উত্তর দিনাজপুরের শীল টি এক্সপোর্টস প্রাইভেট লিমিটেডের অধীন মায়া টি এস্টেটে চালু হয়ে গেছে চা পর্যটন। কাঞ্চনজঙ্ঘার পায়ের কাছে তরাইয়ে আড়াইশো একর জায়গা জুড়ে ছড়ানো মায়া টি এস্টেট। শিলিগুড়ি, বাগডোগরা, বিধাননগর, সোনারপুর শহর ছাড়িয়ে আরও অনেক দূরে। কলাগাছ মোড় পেরিয়ে ‘ইউ’ আকৃতির বাঁক পেরোলেই চা-বাগানের প্রবেশ পথ। পাথর বিছোনো পথ ধরে এগিয়ে গেলে তিন তলা বিশাল বাংলোবাড়ি। বিরাট চৌহদ্দির এক পাশে চা-বাগানের কারখানা। গাছপালায় সাজানো বাগানটির শোভা বাড়িয়েছে ফাইবার গ্লাস ও কংক্রিটের তৈরি নানা ধরনের ভাস্কর্য। ত্রিপুরার শিল্পীদের বাঁশ ও বেতের তৈরি আসবাব দিয়ে সাজানো বসার ঘরের অন্দরসজ্জা। শোবার ঘরের আধুনিক সাজ। গানপাগল বা সিনেমাপ্রেমী বা বইপোকা হলে তাঁদের জন্যেও ব্যবস্থাও রয়েছে। পর্দা সরালেই আদিগন্ত সবুজের হাতছানি। বেতের সোফায় বসে সোনালি চায়ে সমর্পিত এক অন্য সকাল। চা পাতা তোলা থেকে প্যাকেটজাত করার প্রক্রিয়াটি দেখার সুযোগও মিলবে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা মানে টি ট্যুরিজমের ষোলো আনাই মাটি। ফ্যাক্টরিতে ঢুকলেই দেখা যাবে চায়ের পাতা মনোরেল চেপে কী করে ফ্যাক্টরিতে আসে, ড্রায়ারে পাতা শুকোনো, কাটিং, প্যাকেটবন্দি করে বাজারে যাবার জন্য তৈরি হয় কী ভাবে। উদাসী দুপুরে বাতাসে ভাসে চায়ের গন্ধ। ছিপ ফেলে মাছ ধরা বহু দিনের শখ? কাছেই রয়েছে ব্যারন নদী। শুধু মুখ ফুটে জানালে তারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে, আশ্বাস দিচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। এই চা পর্যটনকে কেন্দ্র করেই বিকল্প আয়ের রাস্তা খুঁজে পেয়েছেন বাগানের শ্রমিক পরিবারগুলি। পর্যটকদের দেখভালের দায়িত্ব সামলানো, গাইডের কাজ, রান্নার কাজ, কাছেপিঠের পর্যটনস্থলগুলি ঘুরে দেখাবার জন্য ড্রাইভারের কাজও করছেন তাঁরা। রোজগারের পথ খুঁজে পাবে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তৈরি নাচগানের দলটিও। ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রবীর শীল জানান, চা-বাগানে কাজ করার পাশাপাশি চা পর্যটনের মাধ্যমে শ্রমিকরা রোজগারের নতুন রাস্তা খুঁজে পেয়েছেন। উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত মায় বিদেশি পর্যটকসবার জন্য সাজানো হয়েছে এই মায়া-রাজ্য।

ছবি : অনিতা দত্ত।

অমল প্রকৃতি

আর ক’দিন। তারপরেই ৩৫ বছরে পড়বে নেচার ক্লাব অব আলিপুরদুয়ার। ক্লাবের চেয়ারম্যান অমল দত্ত তখন থেকেই সংগঠনের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। প্রথম দিকে এলাকার কিশোর ও যুবকদের জঙ্গলের সঙ্গে পরিচয় করানো ছিল প্রথম উদ্দেশ্য। সে জন্য বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের জয়ন্তী এলাকায় অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প করেছেন। জঙ্গলে ফাঁদ পেতে খরগোশ, বনমুরগি ধরা শেখানো হতো শিক্ষার্থীদের। শিকারের আনন্দ দিতে নয়, বনে পথ হারালে কী করে বাঁচবে, তার সন্ধান দিতে। ফাঁদে-পড়া খরগোশ বা বনমুরগিদের ধরার পর ছেড়ে দেওয়া হত। তবে সে সব দিন আর নেই। অমলবাবু জানান, বর্তমানে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে কাজ করে তাদের সংগঠন। ধীরে ধীরে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের জন্য শিক্ষার বিষয়ও পাল্টে যায়। প্রথমে মুম্বইয়ের একটি সংস্থার সঙ্গে কাজ করতেন তাঁরা। ১৯৯৩-৯৪ সালে বক্সায় কমলালেবু গাছ কাটা নিয়ে ওই সংগঠনের সঙ্গে মতবিরোধ ঘটে নেচার ক্লাবের। তারা মুম্বইয়ের সংগঠনটির থেকে আলাদা হয়ে যান। নেচার ক্লাব অব আলিপুরদুয়ারের নাম পাল্টে রাখা হয় আলিপুরদুয়ার নেচার ক্লাব। এখনও প্রতি বছর ২৫ ডিসেম্বর জয়ন্তীতে শিশু কিশোরদের নিয়ে হয় প্রকৃতি পাঠ শিবির। বর্ষায় ‘মনসুন ক্যাম্প’ করান বক্সা পাহাড়ে। স্বাধীনতা দিবসের দিন বক্সা দুর্গের মাঠে জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয়। ‘প্রকৃতি’ নামে একটি নিজস্ব ছোট্ট পত্রিকাও রয়েছে সংস্থার। সংগঠনের নিজস্ব লাইব্রেরি থেকে জিম, টেলিস্কোপ সবই রয়েছে। এখন জঙ্গলে কাঠ পাচার, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের বিষয়ে সচেতনতা তৈরির কাজ করছে সংস্থাটি।

স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে

আর্থিক সঙ্কটে জর্জরিত হয়ে কি না করেছেন তিনি। কাপড় সেলাই, ক্যুরিয়ার সার্ভিসে কাজ, জেরক্সের দোকানের কাজ এমনকী ইলেকট্রিক্যাল কাজও। এই সবের মধ্যে দিয়েই শেষ হয়েছিল কলেজ জীবন। জলপাইগুড়ির দেবাশিস চক্রবর্তী কর্মজীবনে জেলা হস্তশিল্প কেন্দ্র এবং জলপাইগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের সঙ্গে যুক্ত। এক দিন হাসপাতাল চত্বরে একটি মূক ছেলেকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে পড়ে যেতে দেখেছিলেন। তখনই সিদ্ধান্ত নেন, এঁদের পাশে দাঁড়ানোর। তখন ২০০৯। মূক বধির ছেলেমেয়েদের তৈরি হস্তশিল্প নিয়ে জেলার হস্তশিল্প মেলায় আত্মপ্রকাশ করে তাঁর সংস্থা “স্বপ্নতোরণ”। আর্থিক সঙ্কট তখনও তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সম্প্রতি প্রাক্তন সাংসদের অর্থানুকূল্যে সংস্থার ভবনটি দ্বিতল হয়েছে। দেবাশিসবাবু জানান, মূক বধির মানুষরাও স্বপ্ন দেখেন। তবে সেই স্বপ্নের কোনও ভাষা থাকে না। সেই ভাষা প্রকাশ করার জন্যই সংস্থার নাম স্বপ্নতোরণ। তিনি জানিয়েছেন, এখানে বাঁশ ও খড়ের কাজ, শুকনো ফুল তৈরি, ক্রিস্টালের কাজ, মাশরুম তৈরি ইত্যাদি শেখানো হয়। দেড়শোরও বেশি মানুষ এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বনির্ভরতার রাস্তা খুঁজে পেয়েছেন। এখন কুড়ি জন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বর্তমানে দাতব্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা, অক্সিজেন পরিষেবা, দর্জির কাজ শেখানো এবং স্বল্পমূল্যে শ্রবণ সহায়ক যন্ত্র মেরামত এগুলিও যুক্ত হয়েছে। কিন্তু আর্থিক সঙ্কট কাটেনি।

ছবি: সুদীপ দত্ত।

এখনও পশ্চিম

১৯৯২-এর পয়লা এপ্রিল সাবেকি পশ্চিম দিনাজপুর জেলা ভেঙে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা গঠিত হয়। বালুরঘাট দক্ষিণ ও রায়গঞ্জ উত্তর দিনাজপুরের সদরের স্বীকৃতি পায়। পশ্চিম দিনাজপুর জেলা ভাগের পর দুই দিনাজপুরে পৃথক সরকারি দফতর তৈরি হলেও এখনও রায়গঞ্জের ব্যবসায়ী সংগঠন পশ্চিম দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্সের নাম বদলে উত্তর দিনাজপুর চেম্বার অফ কমার্স করা হয়নি। জেলা ভাগের দু’দশক পেরিয়ে গেলেও কেন এখনও সংগঠনের নামের আগে পশ্চিম দিনাজপুর শব্দটি লেখা হচ্ছে? সংগঠনের সম্পাদক জয়ন্ত সোমের যুক্তি, ব্যবসায়ীদের অনুরোধে সাবেকি পশ্চিম দিনাজপুরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে সংগঠনের নাম উত্তর দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্স করা হয়নি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংগঠনের নাম দেখে পশ্চিম দিনাজপুর জেলা সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করবে। সংগঠনের বহু ব্যবসায়ী সদস্য দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুর, গঙ্গারামপুর, তপনের বাসিন্দা। জেলাভাগের পর পশ্চিম দিনাজপুর জেলার প্রতি আবেগতাড়িত হয়ে তাঁরা দক্ষিণ দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্সের সদস্য হননি। তাঁদের কথা মাথায় রেখে পশ্চিম দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্স পশ্চিম দিনাজপুরের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। ১৯৮৪ সালে সাবেক পশ্চিম দিনাজপুর জেলার ব্যবসায়ীরা পশ্চিম দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্স গঠন করেন।

বাঁশের পুজো

নানা রূপে দেবতাকে কল্পনা করে মানুষ। কিন্তু বাঁশকে দেবতার প্রতীক বলে চিন্তা করা? তা হয়তো সম্ভব কেবল উত্তরবঙ্গ, উত্তর-পূর্ব ভারতেই। সম্প্রতি দিনহাটা থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ‘কালবৈশাখীর’ গবেষক গোষ্ঠীর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক আলোচনায় লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ দীপককুমার রায় বললেন, বাঁশকেন্দ্রিক লোকাচার এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। উত্তরবঙ্গে বাঁশের পুজোও হয়। উদ্বোধক আনন্দগোপাল ঘোষ বলেন, উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রে হিমালয়ের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। প্রবন্ধ পাঠ করেন অসম, মেঘালয় ও উত্তরবঙ্গের কুড়িজন গবেষক। উত্তরবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারত জীববৈচিত্রে পূর্ণ এক অঞ্চল, যেখানে গাছপালা, ভেষজ, সবই দেশীয় ঐতিহ্যর সঙ্গে, লোকরীতির সঙ্গে ওতোপ্রোত ভাবে যুক্ত। বাঁশকে দেবতা বলে ভাবতে এই অঞ্চলের মানুষের তাই কোনও সমস্যা হয় না।

আকুল-রমণীর গান

এখানে বাড়ির উঠোন থেকে ধানের খেতে হাওয়ায় ভাসে খনের সুর। আপাত শান্ত ওই গ্রামটি তার পরিচয়েই স্বতন্ত্র। পুরনো এক লোকগানের ধারাকে আঁকড়ে রেখে আজ সকলের কাছে খন গানের গ্রাম বলেই পরিচিত দক্ষিণ দিনাজপুরের মহিষবাথান। পাকা রাস্তা থেকে নজর সরে যায় বাঁশ ঝাড়ের পাশে গাছগাছালিতে ঘেরা এক কুঁড়ে ঘরে। ঘরের দাওয়ায় দুই প্রবীণ খনশিল্পী দম্পতিকে ঘিরে খনের আসর বসে। ওই দুই প্রবীণ লোকশিল্পী আকুলবালাদেবী ও তার স্বামী রমণীকান্ত সরকার এখনও ধরে রেখেছেন এই গানের ধারা। আনন্দের সঙ্গে। গর্বের সঙ্গে। এই পুরনো ধারাকে, লোকসংস্কৃতির এই আঙ্গিককে সবার কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করে চলেছেন তাঁরা। কিন্তু অভাবের কষ্ট মাঝেমধ্যেই বাধ সাজছে সেই চেষ্টায়। প্রবীণা আকুলবালা সরকারদের মতো কয়েকজন লোকশিল্পীকে রাজ্য সরকার সম্প্রতি মাসিক ৭৫০ টাকা ভাতা দিচ্ছেন। তাঁর স্বামী রমণীকান্তবাবুও মাসিক ৭৫০ টাকা ভাতার তালিকায় নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু ভবেশ বসাক, ডাকু সরকার, শুকদেব শর্মা, কামেস মাহাতো, বদ্রীনাথ বসাক মতো বহু দুঃস্থ লোকশিল্পী এখনও অসহায়। কিন্তু তাতে কী! প্রবীণা আকুলবালাদেবী তাঁর স্বামী রমণীকান্ত সরকার এখনও কিরণদেব শর্মা, ডাকু শর্মাদের নিয়ে নতুন খনগান তৈরিতে নিজেদের ব্যস্ত রাখেন। মহিষবাথান গ্রামীণ লোকশিল্পী সমবায় সমিতির সম্পাদক পরেশ সরকারের কথায়, “এলাকার জনা তিরিশেক লোকশিল্পী রাজ্য সরকারের ভাতার আওতায় এসেছেন। আরও শিল্পীদের আওতায় আনতে চেষ্টা চলছে।” মহিষবাথানের গর্বের খন গান মূলত পলি এবং রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষেরা গেয়ে থাকেন। রমনীকান্তবাবু বলেন, “মুখে মুখে কথা ও সুর তৈরি করে চলে মহড়া। শুনে শুনে মুখস্থ করতে হয়।” শিল্পীদের সবাইকেই যেহেতু পেটের তাগিদে দিনমজুরি করতে হয়, তাই মহড়ায় ছেদ পড়ে। তাই মন খারাপ কাটে না আকুলবালা-রমনীকান্তর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

north karcha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE