Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
বন্যা-ক্ষতিপূরণ মিলবে কি, আশঙ্কায় বীরভূমের চাষি

দফতরে কর্মী নেই, রাতভর লাইন

হাতে রয়েছে আর সাতটা দিন। তাই খাজনা জমা দিতে রাত জেগে সংশ্লিষ্ট দফতরে হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছেন বহু মানুষ। কিন্তু, দফতরে দিনভর কার্যত অর্ধাহারে কাটিয়েও অধিকাংশ জনই খাজনা জমা দিতে পারছেন না। এর ফলে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে ভুক্তভোগীদের মধ্যে। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে কর্মীর অভাবেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ।

লোকপাড়ায় রাজস্ব পরিদর্শকের অফিসে চাষিদের ভিড়। বৃহস্পতিবার ছবিটি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি।

লোকপাড়ায় রাজস্ব পরিদর্শকের অফিসে চাষিদের ভিড়। বৃহস্পতিবার ছবিটি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি।

অর্ঘ্য ঘোষ
ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৫ ০০:৪১
Share: Save:

হাতে রয়েছে আর সাতটা দিন।

তাই খাজনা জমা দিতে রাত জেগে সংশ্লিষ্ট দফতরে হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছেন বহু মানুষ। কিন্তু, দফতরে দিনভর কার্যত অর্ধাহারে কাটিয়েও অধিকাংশ জনই খাজনা জমা দিতে পারছেন না। এর ফলে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে ভুক্তভোগীদের মধ্যে। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে কর্মীর অভাবেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ।

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রের খবর, জমির খাজনা-সহ আনুষঙ্গিক রাজস্ব জমা দেওয়ার জন্য প্রতিটি পঞ্চায়েত এলাকায় একটি করে আরআই বা রাজস্ব পরিদর্শকের অফিস রয়েছে। ওই সব দফতরে এক জন করে রাজস্ব পরিদর্শক, ভূমি সহায়ক, পিয়ন এবং নৈশপ্রহরী থাকার কথা। কিন্তু, দফতরের বেশ কিছু অফিসে দীর্ঘ দিন ধরে বহু পদ শূন্য রয়েছে। অবসরপ্রাপ্তদের চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ কিংবা এক জন কর্মীকে পালা করে একাধিক জায়গায় দায়িত্ব দিয়ে বছরের পর বছর কাজ চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ। অন্যান্য সময় ওই ভাবে জোড়া তালি দিয়ে কোনও রকমে কাজ চলে গেলেও সম্প্রতি সমস্যা চরম আকার নিয়েছে বলে কর্মীরাই জানাচ্ছেন।

কেন?

সাম্প্রতিক বন্যায় রাজ্য সরকার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে। ওই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অন্যতম শর্তই হল আবেদনপত্রের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে জমির খাজনা জমা দেওয়ার রসিদ। সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতে ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আবেদনপত্র জমা দিতে হবে। তাই খাজনা জমা দেওয়ার জন্য গত কয়েক দিন ধরেই আরআই অফিসগুলিতে হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছেন চাষিরা। তা সত্ত্বেও অনেকেই খাজনা জমা দিতে পারছেন না। কারণ, প্রয়োজনীয় কর্মীর অভাব। আরআই অফিসে খাজনা জমা নেওয়ার দায়িত্ব ভূমি সহায়কের। সপ্তাহে চার দিন তিনি খাজনা তথা রাজস্ব জমা নেন। এক দিন তা জমা করতে যান ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে। কিন্তু, ময়ূরেশ্বরের ঢেকা পঞ্চায়েত এলাকার আরআই অফিসে দীর্ঘ দিন ধরে কোনও রাজস্ব পরিদর্শক, ভূমি সহায়ক এবং নৈশপ্রহরী নেই। ওই দফতরের একমাত্র স্থায়ী কর্মী বলতে রয়েছেন দিলীপ দাস। অবসর প্রাপ্ত কর্মী মদনমোহন সাহাকে ঢেকা-সহ একই সঙ্গে তিনটি পঞ্চায়েত এলাকার রাজস্ব পরিদর্শক হিসাবে চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করানো হচ্ছে। দাসপলশা পঞ্চায়েত এলাকার ভূমি সহায়ক নিখিল ঘোষালকে আবার পালা করে সপ্তাহে দু’দিন করে কাজ করানো হচ্ছে। তাই দু’টি দফতরেই সপ্তাহে মাত্র দু’দিন করে খাজনা জমা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন চাষিরা। স্বাভাবিক ভাবেই খাজনা জমার জন্য ছুটির পরেও কেউ কেউ ভূমি সহায়কের বাড়ি পর্যন্তও দৌড়চ্ছেন বলে অভিযোগ।

বৃহস্পতিবার ভোর ৫টা নাগাদ ঢেকা পঞ্চায়েতের আরআই অফিসের সামনে গিয়ে দেখা গেল পাঁচশোরও বেশি মানুষের ভিড়। তারই মাঝে একধারে বাড়ি থেকে আনা মুড়ি চিবোচ্ছিলেন তাঁতিপাড়ার প্রভাত দাস, কুরিচার প্রফুল্ল গড়াইরা। তাঁরা বলেন, ‘‘দু’দিন না খেয়ে পড়ে থেকেও খাজনা জমা দিতে পারিনি। তাই সবার আগে নাম লেখাব বলে আজ রাত আড়াইটেয় বাড়ি থেকে মুড়ি বেঁধে নিয়েই হাজির হয়েছি। কিন্তু, এসে দেখি আমাদেরও আগে কয়েক জন আরআই অফিসের বারন্দায় মশারি খাটিয়ে শুয়ে রয়েছেন। জানি না আজও খাজনা কাটাতে পারব কি না।’’ শুধু পুরুষেরাই নন, খাজনা জমা দেওয়ার জন্য ভোরবেলায় হাজির হচ্ছেন বিধবা মহিলারাও। বেলেড়ার ভারতী মণ্ডল, গিধিলার গীতা দাসরা বলছেন, ‘‘আমাদের বাড়িতে কেউ নেই। তাই খাজনা জমা দেওয়ার জন্য তিন দিন ধরে ঘুরছি। সময়মতো আবেদনপত্র জমা করতে না পারলে ক্ষতিপূরণের টাকাই তো মিলবে না!’’

একই অবস্থা দাসপলশা পঞ্চায়েত এলাকাতেও। ওই পঞ্চায়েতের ছোটতুড়িগ্রামের রহমত আলি, আর্জুনির ভূদেব বাগদিরা বলেন, ‘‘আমাদের পঞ্চায়েতের ভূমি সহায়ককে দু’দিন ঢেকাতে টেনে নেওয়া হয়েছে। তাই দু’দিন খাজনা জমা দিতে এসে অধিকাংশকেই ঘুরে যেতে হয়েছে। অনেকে ভূমি সহায়কের বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে এসেছেন। উপায় তো নেই। সাত দিনের মধ্যেই খাজনা জমার রসিদ-সহ আবেদনপত্র জমা দিতে হবে।’’ কিন্তু, কাজের যা গতি, তাতে সবার খাজনা জমা দিতে সেই সময়সীমা পেরিয়ে যাবে বলেই তাঁদের আশঙ্কা। এই অবস্থায় অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দাবি তুলেছেন প্রত্যেকেই।

খাজনা জমা দিতে গিয়ে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদেরা হয়রানির পাশাপাশি পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অসাধু কিছু কর্মী ভাল মুনাফাও করছেন বলে অভিযোগ। এ দিকে, অধিকাংশ আরআই অফিসে খাজনা জমা দেওয়ার পুরনো কোনও নথিও নেই। তাই মর্জিমাফিক বকেয়া দেখিয়ে আর্থিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ধারাবাহিক ভাবে ‘অন্য উপায়ে’ হালসাল রসিদ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। ওই অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন ঢেকা-সহ ময়ূরেশ্বর ২ ব্লকের তিনটি আরআই অফিসের রাজস্ব পরিদর্শক মদনমোহন সাহা। তাঁর দাবি, সবাই যাতে ঠিক ভাবে সুযোগ পান, তার জন্য তাঁরা ছুটির দিনেও রাত পর্যন্ত কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ময়ূরেশ্বর ২ ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান, বিভিন্ন আরআই অফিসে বেশ কিছু পদ দীর্ঘ দিন ধরেই শূন্য রয়েছে। এমকী, ব্লক দফতরেও কিছু পদ শূন্য রয়েছে। তাই ব্লক থেকে কোনও কর্মীকে সাময়িক ভাবে তুলে নিয়ে গিয়েও ওই সব এলাকায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাঁর বক্তব্য, ‘‘অস্থায়ী কর্মী নিয়োগের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষ। দু’টি বিষয়েই তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। আমি নিজেও পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ঢেকায় যাচ্ছি।’’ আর্থিক অসঙ্গতির অভিযোগও খতিয়ে দেখার তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। অন্য দিকে, পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে ক্ষতিপূরণের আবেদনপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা বাড়ানোর জন্য প্রশাসনের দৃষ্টি আর্কষণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ময়ূরেশ্বর ২ বিডিও সৈয়দ মাসুদুর রহমান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE