Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বোটে নদী পেরিয়ে সাত দিন পরে স্কুলে পৌঁছল মিতারা

হাতের কর গুণে স্পিড বোটের মধ্যে বসতে বসতে বন্ধুদের বলছিল স্কুল ছাত্রীটি। ‘‘সে হবে গিয়ে গেল মঙ্গলবার!’’ ‘‘কী বলিস মিতা? সাতদিন!’’ স্কুলের বন্ধু পূজা পাল, মহুয়া পাল বা সুকান্ত বাগদিরা সরে গিয়ে জায়গা করে দেয় মিতাকে। নিজেদের ম‌ধ্যে বলাবলি করে, দিন পাঁচ, সাত পর মঙ্গলবার স্কুলে যেতে পারল তারা। নদীর মধ্যেই কথা হয়, কোন পড়া-কোথায় থেমেছিল। সাত দিন বেমালুম ছুটি? ‘‘কি করব, জল না নামা পর্যন্ত স্কুল কেন, বাড়ি থেকেই বের হতে পারিনি যে। এখন স্কুলে যাওয়ার স্পিডবোর্টই ভরসা। এছাড়া কোনও উপায় নেই।’’

ময়ূরাক্ষীতে এ ভাবেই চলছে পারাপার। মঙ্গলবার সকালে ছবিটি তুলেছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

ময়ূরাক্ষীতে এ ভাবেই চলছে পারাপার। মঙ্গলবার সকালে ছবিটি তুলেছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
সিউড়ি শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৫ ০০:৫৩
Share: Save:

হাতের কর গুণে স্পিড বোটের মধ্যে বসতে বসতে বন্ধুদের বলছিল স্কুল ছাত্রীটি।
‘‘সে হবে গিয়ে গেল মঙ্গলবার!’’
‘‘কী বলিস মিতা? সাতদিন!’’
স্কুলের বন্ধু পূজা পাল, মহুয়া পাল বা সুকান্ত বাগদিরা সরে গিয়ে জায়গা করে দেয় মিতাকে। নিজেদের ম‌ধ্যে বলাবলি করে, দিন পাঁচ, সাত পর মঙ্গলবার স্কুলে যেতে পারল তারা। নদীর মধ্যেই কথা হয়, কোন পড়া-কোথায় থেমেছিল।
সাত দিন বেমালুম ছুটি?
‘‘কি করব, জল না নামা পর্যন্ত স্কুল কেন, বাড়ি থেকেই বের হতে পারিনি যে। এখন স্কুলে যাওয়ার স্পিডবোর্টই ভরসা। এছাড়া কোনও উপায় নেই।’’
অজয়পুরের দিকে বোটযাত্রীদের অনুযোগ মিথ্যে নয়। ফি বছর মিতা, পূজা, সুকান্তদের মতো সিউড়ি অজয়পুর হাইস্কুলের পড়ুয়াদের স্কুল যাতায়তের ভরসা বলতে ওই স্পিডবোটই। ভরা ময়ূরাক্ষী পেরিয়ে সম্ভব না হওয়ায় ঘরবন্দি হয়ে কাটাতে হয় এই কদিন তাদের। এ দিনই প্রশাসনের সহযোগিতায় স্কুলে যাওয়া সম্ভব হল। শুধু পুজা বা সুকান্তরাই নয়, মহম্মদবাজার এলাকার বেহিরা, ভেজেনা, ডুমুনি থেকে নদী পেরিয়ে অজয়পুর স্কুলে আসতে হয় অন্তত ৭৫ জন ছাত্র-ছাত্রীকে। প্রতি বর্ষা, ছবিটা একই। বর্ষার জল এবং তিলপাড়া জলাধার থেকে ছাড়া প্রবল জলের তোড়ে তিন কিলোমিটারের মধ্যে দিয়ে নৌকায় চড়ে প্রাণ হাতে করে স্কুলে আসাটাই এখন এই পড়ুয়াদের কাছে যেন ভবিতব্য!
নাগাড়ে বৃষ্টি আর তিলপাড়া থেকে জলের তোড় ময়ূরাক্ষীর চর ভাসায় এ বারও। নদী পথে নৌকো থাকলেও, তার জীর্ণ দশা দেখে এ বার আর সাহসও হয়নি কারও সেই নৌকোয় চেপে ওপারে অজয়পুর ঘাটে যাওয়ার। ওক স্কুল পড়ুয়া বলেন, ‘‘দু’একবার যে বাড়িতে বলিনি তা নয়। কিন্তু, মেঘ মাথায় ওই ছাপুছাপু নদীর দিকে যাওয়ার কথা বলেই বাড়িতে বকুনি খেতে হয়।’’

বেহিরা ঘাট থেকে নৌকোয় যেতে যেতে পড়ুয়ারা কথায় কথায় জানালেন, ব্লক প্রশাসন স্পিডবোটের ব্যবস্থা করাতে কিছুটা সুরাহা হল। জানা গেল, ময়ূরাক্ষীর দুটি শাখানদীর মধ্যে থাকা মহম্মদবাজার ব্লকের শুধু বেহিরা, ভেজেনা বা ডুমুনি কেবল নয়, নরসিংহপুর, বরাম, কুলতোড় গোবিন্দপুরের মতো ১০-১২টি গ্রামের বাসিন্দাদের একই দশা। বর্ষা এলেই তাঁদের অবস্থা অনেকটা দ্বীপের মধ্যে থাকা অধিবাসীদের মতো হয়ে দাঁড়ায়। তাতে অনেক সময়ই কারও সঙ্গে কোনও যোগাযোগও থাকে না।

নদীতে জল বাড়লে স্কুল ছাড়া অন্য কোনও প্রয়োজনে সিউড়ি বা সাঁইথিয়া পৌঁছতে বর্ষায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে একমাত্র নৌকো। বর্ষার পরই যেহেতু জল শুকিয়ে যায় তাই মাত্র কয়েকমাস জন্য নৌকো চলাচলের ব্যাপারেও কোনওদিনই খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি স্থানীয় প্রশাসন। এমন অভিযোগ উঠে আসে, নদী সংলগ্ন গ্রামগুলি থেকেই। দুর্ভোগ তাঁদেরই বেশি। সেই দুর্ভোগের কথাই উঠে এল অজয়পুর স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ভেজেনা গ্রামের সুকান্ত বাগদি, একাদশ শ্রেণির ছাত্রী বেহিরা গ্রামের পূজা পাল, বা নবম শ্রেণির মিতা পালদের কথায়। তারা জানায়, ‘‘বর্ষায় সত্যিই চরম সমস্যা পোহাতে হয় আমাদের। এবার যে নৌকোটা চলাচল করছিল সেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। স্পিডবোট চলুক তবে সব থেকে ভাল হয় যদি শক্তপোক্ত একটা নৌকো দেয় প্রশাসন, যাতে স্কুলে আসতে পারি।’’

বর্ষাকাল জুড়ে ফি বছর দু’ থেকে তিনমাস এভাবে ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করা কিংবা স্কুলে আসতে না পারার বিষয় নিয়েই চিন্তিত স্কুলের শিক্ষকেরাও। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আশিস গড়াই বা অন্যান্য সহ শিক্ষকেরা জানান, স্কুলে না এলে ক্ষতি পড়ুয়াদের। কিন্তু এভাবে ভরা নদী প্রাণ হাতে করে পেরিয়ে আর কতদিন? প্রশাসন অন্তত এর একটা স্থায়ী ও সমাধান বের করুক।

প্রশাসনের একাংশ বলছে, বোট চললেও তা দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব নয়। এ মত অবশ্য স্থানীয়দেরও। পাড়ে দাঁড়িয়ে এক অভিভাবক বলেন, ‘‘প্রতি বারই দেখছি, সমাধান মেলে না কোনও। এত বড় নদী, বর্ষাকাল এলে ভেসে যায়। কানায় কানায় ভরা নদী দেখলে বুক কাঁপে। কী করে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাবো বলুন তো।’’

ময়ূরাক্ষী নদীর জল বৃষ্টি হলে তিলপাড়া জলধারের জল ছাড়ার উপর মূলত নির্ভর করে। তাই নদীতে সবসময় সমান জাল থাকে না। ইচ্ছে মতো বালি তুলে নেওয়ায় নদীগর্ভে তৈরি হয়েছে ভয়াল সব চোরা খাল। কোথাও আবার চর জেগে, কোথাও শুধু জলের তলা থেকে জেগে কাশ বনের মাথা। সেই কাশের বন মাঝে মাঝেই স্পিডবোটের প্রপেলারে আটকে যাচ্ছে। তবু জল কেটে বোট চলে এক পার থেকে অন্য পারের দিকে! নানা অনুযোগ আর অভিযোগের মাঝেই কাশের মাথায় লেগে অজয়পুর ঘাটের আগেই থেমে গেল বোট।

আতঙ্কিত বোটভর্তি পড়ুয়া-মুখ। ভরসা দেন মধুসূদন কোনার। বর্ধমান থেকে স্পিডবোট চালাতে এসেছেন তিনি। জলে নেমে সন্তর্পনে প্রপেলারের জট ছাড়িয়ে দেন।

মহম্মদবাজারের বিডিও সুমন বিশ্বাস বলেন, ‘‘নরসিংহপুরের জন্য একটি নৌকো দেওয়া হয়েছে। বেহিরা থেকে অজয়পুর ঘাট পর্যন্ত চলাচলের জন্য নৌকোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শীঘ্রই নৌকো চলে আসবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE