Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

লুপ্তপ্রায় বোলান গানের ভবিষ্যৎ কী, প্রশ্ন মঞ্চে

তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’ থেকে হাল আমলের ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’— বাংলার সাহিত্য, সিনেমায় বারবার ফিরে এসেছে এই গানের অনুষঙ্গ। কিন্তু হারিয়ে যেতে বসেছে বোলানের সুর। সেই সুরকেই ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করল সাঁইথিয়ার হরিশাড়ার ভবানীপুর সপ্তপ্রদীপ সংস্কৃতি সোসাইটি।

বোলান বাঁচাতে নাটক। —নিজস্ব চিত্র।

বোলান বাঁচাতে নাটক। —নিজস্ব চিত্র।

অনির্বাণ সেন
সাঁইথিয়া শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৫ ০২:১৩
Share: Save:

তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’ থেকে হাল আমলের ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’— বাংলার সাহিত্য, সিনেমায় বারবার ফিরে এসেছে এই গানের অনুষঙ্গ। কিন্তু হারিয়ে যেতে বসেছে বোলানের সুর। সেই সুরকেই ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করল সাঁইথিয়ার হরিশাড়ার ভবানীপুর সপ্তপ্রদীপ সংস্কৃতি সোসাইটি। তাদের সাম্প্রতিক প্রযোজনা ‘বোলান ফিরবে?’ দর্শককে ভাবিয়ে তোলে বাংলার এই প্রাচীন লোকগানটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে।

নাটকের মূল চরিত্র গোবিন্দপুর গ্রামের বোলান শিল্পী শিবু বাগদি। শিবুর ‘ক্ষ্যাপাকালী’ নামের বোলান দলটি শ্মশানে বোলান গাইতে গাইতেই শহরে যাওয়ার সুযোগ পায়। তবে শহরের এক ‘বাবু’ প্রচলিত আধুনিক সুরের অনুষঙ্গে বোলান বেচবার পরিকল্পনা করে। শিবু, তার বউ কমলা দলসমেত গ্রামে ফিরে আসা স্থির করে। শহরের সেই ‘বাবু’ বোলান গানের খাতা পাওয়ার জন্য শিবুকে লোক লাগিয়ে খুন করে। গ্রামে ফিরে ছেলে লখুকে নিয়ে শুরু হয় কমলার দিন যাপন। শিবুর মৃত্যুর সঙ্গে গ্রামে বন্ধ হয়ে যায় বোলান গানও। চলতি বছরে ধরম পুজোর গাজনে গ্রামের বাবুরা ভিন্ গ্রাম থেকে বোলান দল ভাড়া করে আনবে বলে ঠিক করে। গোবিন্দপুরের ‘বোলান পরিবার’টির মাথা হেঁট হয়ে যায়। স্থির হয় শিবুর ছেলে লখু বোলান গাইবে। কমলা যদিও তাতে আপত্তি করে। কিন্তু একদিন গভীর রাতে নাছোড় লখু বাবার পোশাক আর ঢোল নিয়ে ঘর ছাড়ে। সেই রাতেই শহরের ‘বাবু’দের প্রলোভনে পড়ে শিবুর এক কাকিমা বোলানের খাতা চুরি করে পাচার করে দেয়।

নাটকের কয়েকটি সংলাপ দর্শকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে দেয়। ‘বাপ সবই মানি লিলাম, কিন্তু বোলন গানে কি হিন্দি গানের সুরটো বাজে? রাজনীতির দালালদের কথায় সুরের বিকৃতি ঘটিং ওদের গোলামিঠো খাটে’— লখুর এই আক্ষেপ খুবই স্বাভাবিক। চিন্তাশীল দর্শকের মনে উঁকি দিতে পারে গ্রামসির ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদে’র কথা। সাম্প্রতিক কয়েকটি নির্বাচনেও দেখা গিয়েছে, বোলানের সুর বিকৃত করে প্রচার অভিযান চালিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলি। নির্দেশকের ইঙ্গিত কি সে দিকেই?

বঙ্গীয় শব্দকোষ ঘাঁটলে দেখা যায়, ‘বোলান’ শব্দের অর্থ সম্ভাষণ বা প্রবচন। মতান্তরে ‘বুলা’ বা ভ্রমণ থেকেও বোলান গানের উৎপত্তি হতে পারে বলে মনে করেন একদল লোক গবেষক। বাংলায় তুর্কি আক্রমণের পর থেকে শিবের গাজন উপলক্ষে বোলান গান গাওয়া শুরু হয়। বোলান গানের মূলত ৪টি প্রকার— দাঁড় বোলান, পালা বোলান, সখী বোলান ও শ্মশান বোলান। এক সময় বীরভূম, নদিয়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ এলাকায় বোলান গান প্রচলিত ছিল। বিশিষ্ট লোক সংস্কৃতি গবেষক ওয়াকিল আহমেদ তাঁর ‘বাংলার লোকস্কৃতি’ বইতে লিখেছেন, ‘‘বোলান গান বাঁধা হয় পালার আকারে। এতে লঘু, গুরু উভয় বিষয়েরই স্থান আছে। গুরু বিষয় খণ্ডগীতি, আর লঘু বিষয় রঙপাঁচালি নামে পরিচিত।’’ এখানে একটি দল যখন গায়, অন্য দল ধুয়া দেয়। এ ভাবেই এগিয়ে চলে বোলান। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাদু, আলকাপ প্রভৃতি লোকশিল্পের মতোই বোলানের ঐতিহ্যও ফিকে হয়ে এসেছে।

নাটকের নির্দেশক সুব্রত ঘটক মঞ্চকে দু’টি ভাগ করেছেন। এক দিকে শিবু বাগদির ঘর। অন্যদিকে ঝুরি নামা প্রাচীন বট গাছ, যেখানে বসত বোলানের আসর। বট গাছটি যেন খানিকটা প্রতীকী। অনুষঙ্গে হারমোনিয়ামের সাবলীল ব্যবহার। বোলানের একটি বিশেষ দিক সমাজ সচেতনতার প্রচার। ‘কালের রাখাল ডাক দিয়েছে আইরে দেখে যা/ যে মেয়েটার পড়ার সময় তার কোলেতে ছা’— স্পষ্টতই যেন বাল্য বিবাহ রোধের বার্তা।

হঠাৎ করে বোলানকে মঞ্চে আনা হল কেন?

সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘লুপ্তপ্রায় লোকগানকে সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মকে আগ্রহী করে তুলতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’’ নাটকটি প্রথম প্রযোজিত হয় আমোদপুর নাট্য তীর্থের উৎসবে। সেটা ২০১৪ সাল। তারপর থেকে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অ্যাকাডেমি, দক্ষিণ ২৪ পরগনার আটেশ্বর তলা, ময়নাগুড়ি, আসানসোলের দোমহানি বাজার, বর্ধমানের ধবনীগ্রামে, সাঁইথিয়া রবীন্দ্র ভবন— মোট ১৯ বার নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে সুব্রত, অরূপ, খোকন, মল্লিকা, দোলাদের অভিনয় বেশ ভাল।

তবে নাটকের শেষেও বোলানের ভবিষ্যৎ নিয়ে যেন একটা আশঙ্কার সুর বাজতে থাকে। দর্শকেরাও সেই আশঙ্কার শরিক যেন। যেমন, প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয় বীরভূমের ময়ূরেশ্বর হাইস্কুলের শিক্ষক ও লোকশিল্প গবেষক আদিত্য মুখোপাধ্যায় বলে ফেলেন, ‘‘বছর পাঁচেক পরে বোলান গান থাকবে বলে মনে হয় না। তবে ‘বোলান ফিরবে?’-র প্রযোজনাতে প্রাচীন বোলানের আঙ্গিকটি ফুটে উঠেছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bolan gan tarasankar anirban dey sainthia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE