Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মেডিক্যালের খাতাই দিল বাবার খোঁজ

বুধবার সকালে আমড়াতলা জঙ্গলে ছাতু কুড়োতে গিয়ে স্থানীয় মহিলারা ওই শিশুর কান্না শুনতে পান। স্থানীয় মাজডিহা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান বিশ্বেশ্বর মণ্ডল ঘটনাটি সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ও ব্লক প্রশাসনকে জানান।

প্রতীকী চিত্র।

প্রতীকী চিত্র।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৭ ১৩:২৪
Share: Save:

কখনও রাস্তার পাশে, কখনও ঝোপ ঝাড় থেকে কান্নার শব্দ শুনে উদ্ধার হয় সদ্যোজাতেরা। নিজের পরিচয় বা বাবা-মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েই হোমে বেড়ে ওঠে ওই শিশুরা। সে দিক থেকে ব্যতিক্রম ওন্দার আমড়াতলা শাল জঙ্গল থেকে উদ্ধার হওয়া মাস সাতেকের মৌমিতা। তার পায়ের ক্ষতই খুঁজে দিল তার পরিচয়, বাবা-মাকেও। আর তা সম্ভব হল, বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ, চাইল্ড লাইন ও জেলা প্রশাসনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়।

বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যাচ্ছে, ২০১৪ সালের জুলাই মাস থেকে এখনও পর্যন্ত এই জেলায় ১৭ জন পরিত্যক্ত শিশু উদ্ধার হয়েছে। যার মধ্যে মৌমিতাই একজন, যার পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসুর কথায়, “বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ, ওন্দা ও বিষ্ণুপুরের বিডিও এবং চাইল্ড লাইন— সকলের একত্রিত প্রচেষ্টাতেই এই সাফল্য মিলেছে।”

বুধবার সকালে আমড়াতলা জঙ্গলে ছাতু কুড়োতে গিয়ে স্থানীয় মহিলারা ওই শিশুর কান্না শুনতে পান। স্থানীয় মাজডিহা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান বিশ্বেশ্বর মণ্ডল ঘটনাটি সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ও ব্লক প্রশাসনকে জানান। বিডিও (ওন্দা) শুভঙ্কর ভট্টাচার্যের কথায়, “ওই শিশুকন্যার ডান পায়ে সংক্রমণ দেখেই তার কোথাও চিকিৎসা করানো হয়ে থাকতে পারে আমাদের সন্দেহ হয়েছিল।” সেই সন্দেহই শেষ পর্যন্ত সত্যি হল।

বাঁকুড়া চাইল্ডলাইনের কো-অর্ডিনেটর সজল শীল জানান, বাঁকুড়া মেডিক্যালে শিশুটিকে ভর্তি করার পরেই সেখানকার নার্সরা তাকে চিনতে পারেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের ‘রেজিস্ট্রার বুক’ খুলে খোঁজ শুরু করেন। বৃহস্পতিবার ওই শিশুটির পরিচয় খুঁজে পান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। জঙ্গলে উদ্ধার হওয়ার দু’দিন আগেই বন্ড দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে বাড়ির ঠিকানা লেখা ছিল বিষ্ণুপুর থানার লোকেশোল গ্রাম। ঠিকানাটি পেয়েই সজলবাবু সরাসরি জেলাশাসক মৌমিতাদেবীর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে সব জানান। রেজিস্ট্রার বুকে লেখা ওই শিশুটির বাবার নামও বলেন।

মৌমিতাদেবী বিডিও (বিষ্ণুপুর) জয়তী চক্রবর্তীকে ফোন করে দ্রুত লোকেশোল গ্রামে গিয়ে ওই শিশুটির বাবার খোঁজ করতে নির্দেশ দেন। জয়তীদেবী ওই গ্রামে গিয়ে শিশুটির বাবার খোঁজ শুরু করেন। যদিও ওই শিশুর বাবার হদিস কেউ দিতে পারেননি। দিনভর লোকেশোল ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে জয়তীদেবী খোঁজ চালান। স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদেরও সাহায্য নেন তিনি। শেষে লোকেশোল সংলগ্ন পাঁচাল গ্রামের এক ব্যক্তি ওই শিশু কন্যার বাবার নাম চিনতে পারেন। তিনি জানান, ওই নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে লোকেশোল গ্রামের এক মহিলার বিয়ে হয়েছে। তাঁরা এখন দুর্গাপুরে থাকেন। এরপর ওই শিশুর মামারবাড়ির হদিস পান জয়তীদেবী। সেখান থেকে শিশুটির বাবার ফোন নম্বর নিয়ে ফোন করে দ্রুত বাঁকুড়া মেডিক্যালে আসতে বলেন।

শুক্রবারই ওই দম্পতি বাঁকুড়া মেডিক্যালে এসে নিজেদের শিশুকে চিনতে পারেন। কী ভাবে শিশুটিকে জঙ্গলে নিয়ে গেলেন তিনি? মঙ্গলবার ওই বধূ দাবি করেন, বাঁকুড়া মেডিক্যাল থেকে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে তিনি মাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেন। শিশুটিকে নিয়ে তিনি দুর্গাপুরে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবেন বলে জানিয়েছিলেন। এরপর ওই বধূর মা বাস ধরে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। কিছুক্ষণ পরে বাঁকুড়া মেডিক্যাল থেকেই একটি গাড়ি ভাড়া করে আমড়াতলা জঙ্গলে তিনি যান। গাড়ির চালককে তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর কোলের শিশুটি মারা গিয়েছে।

চালকের সন্দেহ হয়নি? তাঁর উত্তর, “সন্দেহ হয়নি। উনি বাচ্চাটিকে দেখতেও চাননি।” ওই বধূর দাবি, এরপর জঙ্গল থেকে কিছুটা দূরে গাড়ি থামিয়ে শিশুটিকে কোলে নিয়ে তিনি জঙ্গলে ঢুকে যান। তার পর একটি গাছের তলায় তোয়ালে পেতে তার উপরে শিশুটিকে শুইয়ে দিয়ে গাড়িতে ফিরে আসেন। তিনি দাবি করেছেন, সেখান থেকে সোজা চলে যান ওন্দা গ্রাম স্টেশনে। এরপর ট্রেন ধরে বাঁকুড়ায় ফিরে বাসে চড়ে দুর্গাপুরে যান।

সেই মেয়েকে ফিরে পেয়ে এখন তাঁর অনুশোচনা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন ওই বধূ। এ দিন তিনি দাবি করেছে, “আমিই হাসপাতাল থেকে ছুটি করিয়ে আমড়াতলার জঙ্গলে মেয়েকে ফেলে দিয়ে এসেছিলাম। আমার স্বামীকে জানিয়েছিলাম সে মারা গিয়েছে। এখন নিজের ভুল বুঝতে পারছি।”

জঙ্গলে উদ্ধার করা মৌমিতাকে তাই হোমে নয়, তার বাবা মায়ের কাছেই ফিরিয়ে দিতে পারবে ভেবে খুশি বাঁকুড়ার প্রশাসনিক কর্তারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bankura Medical College Newborn
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE