Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘কিচ্ছু হবে না’ বলেই ঢলে পড়ল কালো

গর্ত থেকে টেনে বার করতে গিয়ে গোখরোর ছোবল খেয়েছিলেন তিনি। ওই অবস্থাতেই মুখ চেপে ধরে সাপটিকে গলায় ঝুলিয়ে দু’ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হাজির হলেন সেই যুবক।

গোখরোকে হাতে ধরে  ফেলেছেন কালো। (ডান দিকে)  ছোবল খাওয়ার পরে হাতে পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে কাপড়। —নিজস্ব চিত্র।

গোখরোকে হাতে ধরে ফেলেছেন কালো। (ডান দিকে) ছোবল খাওয়ার পরে হাতে পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে কাপড়। —নিজস্ব চিত্র।

ভাস্করজ্যোতি মজুমদার
মহম্মদবাজার শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৫ ০০:৪২
Share: Save:

গর্ত থেকে টেনে বার করতে গিয়ে গোখরোর ছোবল খেয়েছিলেন তিনি। ওই অবস্থাতেই মুখ চেপে ধরে সাপটিকে গলায় ঝুলিয়ে দু’ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হাজির হলেন সেই যুবক।

তবে, শেষরক্ষা হয়নি। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে হাসপাতাল যাওয়ার পথেই ঢলে পড়েন ওই যুবক। রবিবার দুপুরে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে মহম্মদবাজারের রাজ্যধরপুর গ্রামে। পুলিশ জানায়, স্বপন মাল ওরফে কালো (১৮) নামে ওই যুবকের বাড়ি ওই গ্রামেই। মহম্মদবাজারের বিএমওএইচ জাহিরুল আলম বলেন, ‘‘ছেলেটার সারা শরীরে বিষ ছড়িয়ে গিয়েছিল। তবু শেষ চেষ্টা হিসেবে সিউড়ি সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু, সেখানে পৌঁছনোর কিছু ক্ষণের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়।’’

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মৃত যুবকের বাবা দীনু মাল এলাকায় দুঃসাহসী মানুষ হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন। যে কোনও সাপকে তিনি নিমেশে ধরে ফেলতেন। কাছেপিঠে কোথাও সাপ দেখা গেলেই তাঁর ডাক পড়ত। কয়েক বছর আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর ছেলে কালো দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন। তাঁরও বাবার মতোই ডাকাবুকো স্বভাব ছিল। এ দিন তাঁদের প্রতিবেশী আকাই শেখের বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে একটি জৈবসারের গাদার গর্তে বাসিন্দাদের একাংশ একটি গোখরো সাপ দেখতে পান। সাপ দেখতে গ্রামবাসীরা সেখানে ভিড় করেন। খবর পেয়ে গর্তের কাছে চলে আসেন কালোও।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তপন মাল, সুকুমার মালরা, সমীর দাসরা জানান, বাইরে থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল গর্তের ভিতরে সাপটি গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে রয়েছে। বাইরে থেকে কেবল তার লেজ বোঝা যাচ্ছে। সাপটিকে কীভাবে বের করা যায়, তা নিয়েই তখন ভাবছিলেন বাসিন্দারা। ওই সময় হঠাৎ-ই বাকিদের সরিয়ে এগিয়ে আসেন কালো। তাঁদের কথায়, ‘‘সকলের নিষেধ অমান্য করে কালো অবলীলায় গর্তে হাত ঢুকিয়ে সাপটির লেজ ধরে টান দেয়। তাতেই গোখরোটি খেপে গিয়ে ওর বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের কাছে ছোবল মারে। কিন্তু, কালো একেবারেই ঘাবড়ে যায়নি। সাপটিকে লেজ ধরে বের করেই ছাড়ে।’’ কিন্তু, ছোবল খেয়ে নই অসুস্থ বোধ করছিলেন ওই যুবক।

গ্রামবাসীরা জানান, ছোবল খাওয়া হাত দিয়েই মুখ চেপে ধরে গোখরোটিকে গলায় জড়িয়ে ফেলেন কালো। বিপদ বুঝে তপনবাবুরা কালোর হাতে কাপড় বেঁধে দেন। ওই অবস্থাতেই ওই যুবক দু’ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে সটান হাজির হন স্থানীয় পটেলনগর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। তাঁর পিছু পিছু গ্রামবাসীও। কর্তব্যরত চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্যকর্মী, বিষধর সাপ গলায় কালোকে দেখে অবাক হয়ে যান প্রত্যেকেই। ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নার্স পূর্ণিমা মুখোপাধ্যায়, শিখা সরকাররা বলেন, ‘‘এ রকম দৃশ্য কোনও দিন দেখিনি। ছেলেটার গলায় আস্ত গোখরো। প্রচুর লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা সাপটিকে ছেলেটার গলা থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন।’’ এর ফলে সাপটি কালোর গলা থেকে নীচে পড়ে যায়। গ্রামেরই কিছু ছেলে একটি পাত্র দিয়ে সাপটিকে চাপা দিয়ে দেয়। পূর্ণিমাদেবীরা আরও বলেন, ‘‘এত কিছু ঘটছিল, ছেলেটা কিন্তু অবিচল ছিল। সমানে বলে যাচ্ছিল, ‘আমি ঠিক আছি। আমার কিচ্ছু হবে না। দেখুন সাপটিকে ধরে এনেছি। আমাকে ইঞ্জেকশন যা দেওয়ার দিন’। এর পরেই ওর চিকিৎসা শুরু হয়।’’

ঘটনার সময় প্রসূন গোস্বামী ছিলেন কর্ত্যরত চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘‘ওকে বেডে শুইয়েই এভিএস ইঞ্জেকশন দিই। কিন্তু, তত ক্ষণে ওর মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোতে শুরু করেছিল। কিছু ক্ষণের মধ্যে ঢলেও পড়ল। বিপদ বুঝে তাই সদর হাসপাতালে রেফার করি।’’ সিউড়ি অবধি পৌঁছতে পেরেছিলেন কালো। কিন্তু, গোটা শরীরটাই প্রায় নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। সেখানে চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।

এ দিকে, বাবার মৃত্যুর পরে মা এবং ছোট ভাইকে নিয়ে গোটা সংসারের ভারটাই এসে পড়েছিল কালোর উপর। দিনমজুরি করে ওই যুবকই পরিবারে অন্ন জোগাতেন। সেই ছেলেই এমন বেঘোরে মারা যাবে, তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না মা সুষমাদেবী। এ দিন বিকেলে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘‘ছেলেই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল। ওর বাবা সাপ ধরলেও কালো কখনও সাপ ধরেনি। ও যে কেন কারও বারণ শুনল না। সব শেষ হয়ে গেল!’’ দিনের শেষে গ্রামবাসীর কাছেই রয়েছে ঘাতক সাপটি। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বন দফতরের মহম্মদবাজারের রেঞ্জার জ্যোতিপ্রকাশ গুহরায় বলেন, ‘‘আপনার কাছেই ঘটনার কথা প্রথম শুনলাম। দেখে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE