সবার-মাঝে: ক্লাসঘরে মঙ্গলা (কমলা ওড়না)। ছবি: শুভ্র মিত্র
স্কুলে চলল মঙ্গলা সাঁতরা। সাদা সালোয়ার, কমলা ওড়না। সঙ্গে বেগুনি রঙা ব্যাগ। সাত মাস পরে বুধবার মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিতে নিজেই রিকশা টানছিলেন জগন্নাথ সাঁতরা। মঙ্গলার মনে দোলাচল, স্কুলের সবাই আগের মতোই তার সঙ্গে সহজ ব্যবহার করবে তো? মেয়ের হাতে হাত রেখে ভরসা দিচ্ছিলেন তার মা বাতাসি সাঁতরা।
একশো শতাংশ প্রতিবন্ধী ক্ষীণদৃষ্টির মঙ্গলা পর পর দু’বার পরীক্ষায় ফেল করায় স্কুল তাকে আসতে বারণ করেছিল বলে অভিযোগ। কিন্তু হাল ছাড়েনি মঙ্গলা। গত সাত মাস ধরে সকাল-সন্ধ্যা আতস কাচ দিয়ে বই পড়ে গিয়েছে সে। শেষে তার চাপেই জগন্নাথবাবু স্কুল ও প্রশাসনের কাছে মেয়েকে স্কুলে ফেরানোর আর্জি নিয়ে যান। প্রশাসন নড়েচড়ে বসতেই টনক নড়ে স্কুলের। সম্প্রতি মঙ্গলবার বাড়িতে গিয়ে তাকে স্কুলে আসতে বলেন প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকেরা।
তাই এ দিন সকাল থেকেই মঙ্গলার বাড়িতে তুমুল ব্যস্ততা। জগন্নাথবাবু সকালেই নিজের রিকশা সাফসুতরো করে রাখেন। বাতাসিদেবী লোকের বাড়ির পরিচারিকার কাজ করেন। একবাড়ির কাজ সেরে অন্য বাড়িতে যাওয়ার ফাঁকে মেয়ের বই-খাতা ব্যাগে ভরে দেন। মঙ্গলাও সকাল সকাল স্নান সেরে এতদিন ধরে যত্ন করে গুছিয়ে রাখা স্কুলের ইউনিফর্ম পরে তৈরি।
মঙ্গলা ফের স্কুলে যাচ্ছে শুনে দেখা করতে এসেছিল পড়শি সহপাঠী বর্ষা সাঁতরা, সন্তু লোহার। তারা বলে যায়, ‘‘চিন্তা করিস না। স্কুলে এতদিন যা পড়া হয়েছে, আমরা সবাই মিলে তোকে দেখিয়ে দেব। তুই চল মঙ্গলা।’’ সাহস দিতে এসেছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলর দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
তবুও মেয়ের মনে সংশয় খেলা করে। কিন্তু স্কুলের দরজায় রিকশা থামতেই সব দুঃশ্চিন্তা ঘুচে গেল তার। হই হই করে ছুটে এল নবম শ্রেণির ‘বি’ সেকশনের ঊর্মিলা সরকার, মল্লিকা হালদার, রিমা দাস। তারা কার্যত ছোঁ মেরে মঙ্গলাকে টেনে নিল। তাকে টেনে নিয়ে গেল ক্লাস ঘরে। অন্য বান্ধবীরাও এগিয়ে এসে মঙ্গলাকে বেঞ্চে বসিয়ে দিল। তারপর তাদের কত প্রশ্ন। এতদিন পরে বন্ধুদের পেয়ে খোশ গল্পে মেতে উঠল মঙ্গলাও। এটাই তো চাইছিল সে।
বিষ্ণুপুর মিশন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অজয় হেমব্রম বলেন, ‘‘মঙ্গলার অবিভাবকের সঙ্গে কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। এখন সব মিটে গিয়েছে। মঙ্গলা আগের মতো অন্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ক্লাস করবে। আমাদের মিশন স্কুলে দুঃস্থ পরিবারের ছেলেমেয়েরাই বেশী পড়াশোনা করে। সে যে ইউনিট টেস্টগুলোতে পিছিয়ে পড়েছে, আমরা শিক্ষকেরা ওকে আগলে রেখে সব তৈরি করে দেব।’’
স্কুলের বাংলা বিষয়ের শিক্ষিকা মিঠু ঠাকুরতা, ভূগোলের সুচেতা দাস পরম স্নেহে তখন কাছে টেনে নিয়েছেন মঙ্গলাকে। এতদিন ধরে স্কুলে ফেরার জেদ ধরে মেয়ের চোখে তখন জল। পরে সে বলে, ‘‘স্কুলে ফিরে কি যে ভাল লাগছে বোঝাতে পারছি না।’’
মেয়েকে স্কুলে ঢুকিয়ে ফেরার সময় সাঁতরা দম্পতির মুখেও তৃপ্তির হাসি। তাঁরা বলেন, ‘‘মেয়ে যে সত্যিই কোনও স্কুল যেতে পারবে ভাবিনি। প্রশাসন ও স্কুল কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসাতেই তা হল।’’
বিষ্ণুপুরের সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) সঞ্জীব দাস চক্রবর্তী বলেন, ‘‘শুধু প্রতিবন্ধীই নয়, কাউকেই স্কুল আসতে বারণ করা যায় না বর্তমান সময়ে। স্কুল কর্তৃপক্ষ মেয়েটিকে শেষ পর্যন্ত ফিরিয়ে নেওয়ায় ভাল হয়েছে। তবে আমি নজর রাখব। মঙ্গলা নিয়মিত ক্লাস করছে কি না, তা দেখতে ওই স্কুলে পরিদর্শনেও যাব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy