Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
বাঁকুড়ায় সাধুবাদ

রেফার না করে লড়াই ডাক্তারের

সাবিত্রী হাঁসদা। নিজস্ব চিত্র

সাবিত্রী হাঁসদা। নিজস্ব চিত্র

শুভ্র মিত্র ও রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
সোনামুখী ও বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৭ ০৩:৩৬
Share: Save:

গোড়ালি থেকে রক্ত ঝরছে। বৃদ্ধ বারবার বলে যাচ্ছিলেন, জমিতে পড়ে থাকা কুকুরের খুলির হাড় ভেঙে তাঁর পায়ে বিঁধে গিয়েছে। কিন্তু বৃদ্ধের পেট ব্যথা, ঢুলু ঢুলু চোখ দেখে চিকিৎসকের সন্দেহ হয়, সাপে কাটেনি তো! ‘রেফার’ না করে নিজেই টেস্টটিউব নিয়ে রোগীর রক্ত টেনে পরীক্ষা করে বাঁকুড়ার সোনামুখী গ্রামীণ হাসপাতালের চিকিৎসক সাবিত্রী হাঁসদা নিশ্চিত হন, তাঁর আশঙ্কাই সত্যি। শুরু করে দেন, সোনামুখীর মদনমোহনপুরের বৃদ্ধ নরেন বাগদির সাপে কাটার চিকিৎসা। শুক্রবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চিকিৎসা করে প্রাথমিক ঝুঁকি কাটিয়ে বৃদ্ধকে বাঁকুড়া মেডিক্যালে স্থানান্তর করেন তিনি।

শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃদ্ধের বিপদ সম্পূর্ণ না কাটলেও সোনামুখীতে সময়েই যে তার চিকিৎসা শুরু হয়েছে, তা মানছেন বাঁকুড়া মেডিক্যালের চিকিৎসেরা। বাঁকুড়া মেডিক্যালের সুপার শুভেন্দু বিকাশ সাহা বলেন, “ওই রোগীর ডায়ালিসিস করানো হয়েছে। চিকিৎসায় তিনি সাড়া দিলেও এখনও পুরোপুরি বিপন্মুক্ত বলা যাবে না। তবে এটা ঠিক, সময়ে এভিএস (অ্যান্টি ভেনম সিরাম) পড়েছে বলেই রোগীর চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। কারণ সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রতিটি মুহূর্ত খুবই মূল্যবান।’’

তাই মেডিক্যালে দাঁড়িয়েও বারবার সোনামুখী গ্রামীণ হাসপাতালের চিকিৎসককে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন নরেনবাবুর বড় ছেলে মানিক বাগদি। মানিকবাবু বলেন, “বাবা তো বুঝতেই পারেনি, তাকে সাপে কেটেছে। গ্রামীণ হাসপাতালের ডাক্তার যদি ধরতে না পারতেন, তাহলে এতক্ষণে কী ঘটে যেত, ভেবে ভয় পাচ্ছি।”

মানিকবাবু জানান, শুক্রবার দুপুরে বাড়ির অদূরে একটি মাঠে ঘাস কাটতে গিয়েছিলেন তাঁর বাবা। মাঠের মধ্যে একটি কুকুরের মাথার খুলি পড়েছিল। অসাবধানতায় ওই খুলিতে নরেনবাবুর ডান পা পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই গোড়ালিতে তীব্র যন্ত্রনা শুরু হয়। দেখেন পা দিয়ে রক্ত ঝরছে। প্রথমে নরেনবাবুর মনে হয়েছিল, খুলির হাড়ই বুঝি তাঁর পায়ে বিঁধে গিয়েছে। কোনও রকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ি পৌঁছেই তিনি ছেলেকে ঘটনাটি জানান।

বাড়ির লোকজন ফেলে না রেখে ভ্যানোতে তাঁকে চাপিয়ে গ্রাম থেকে চার কিলোমিটার দূরের সোনামুখী গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যান। তাঁকে পরীক্ষা করেন হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার সাবিত্রী হাঁসদা। তিনি জানান, নরেনবাবুর পেটে ব্যথা হচ্ছিল, চোখ বুজে আসছিল, গায়ে জ্বরও এসেছিল। এ ছাড়া পায়ে হাড় বিঁধলে ক্ষত যতটা গভীর হওয়ার কথা, ততটা হয়নি। তাই প্রথম থেকেই তাঁর মনে হয়েছিল, বৃদ্ধকে সাপে কেটে থাকতে পারে।

চিকিৎসার ফাঁকেই ঘটনাটি নিয়ে রাজ্যের সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসকদের ‘হোয়্যাটস অ্যাপ’ গ্রুপেও তিনি আলোচনা চালাতে থাকেন। সেই গ্রুপে বিশেষজ্ঞেরা সাবিত্রীকে পরামর্শও দেন। পরপর দু’বার নরেনবাবুর রক্ত পরীক্ষা করেন তিনি। তাতেই নিশ্চিত হন, নরেনবাবুকে সাপেই কেটেছে। এরপরেই তাঁকে সাপে কাটার ভ্যাকসিন দিয়ে ঝুঁকি না নিয়ে বাঁকুড়া মেডিক্যালে ‘রেফার’ করেন তিনি।

সাবিত্রী বলেন, “কুকুরের হাড় বিঁধলে রোগীর পেটে যন্ত্রণা বা ঝিমিয়ে পড়া ভাব হতো না। এ ছাড়া রক্ত পরীক্ষা করে দেখলাম, রক্ত জমাট বাঁধছে না। যা থেকে নিশ্চিত হলাম ওই রোগীকে বিষধর সাপে কেটেছে। এরপরেই সাপে কাটার ক্ষেত্রে চিকিৎসা শুরু করার যে নিয়ম রয়েছে, তা মেনে ওষুধ দেওয়া শুরু করি।”

বাঁকুড়ার কেন্দুয়াডিহির চন্দনকেয়ারির তরুণী সাবিত্রীর কর্মজীবন শুরু হয় উত্তরবঙ্গে। ২০১৪ থেকে তিনি সোনামুখী গ্রামীণ হাসপাতালে রয়েছেন। সেই থেকে সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা করে আসছেন। তাই এ ক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতাও কম নয়। তিনি বলেন, ‘‘সোনামুখীতে প্রায়ই সাপে কাটা রোগী আসেন। মাসে গড়ে সাপে কাটা ১৫টা রোগীকে চিকিৎসা করতে হয়। জুলাই মাসে বিষ্ণুপুরে সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসার একটি কর্মশালাতে গিয়েছিলাম। তাও বেশ কাজে দিয়েছে।’’

রাজ্যে যেখানে নিচুতলার বহু স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিরুদ্ধে ঝুঁকি না নিয়ে হুট করতেই রোগীদের জেলা হাসপাতাল বা মেডিক্যালে স্থানান্তর করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে, সেখানে দায়িত্বশীল চিকিৎসকের ভূমিকায় সাবিত্রীর ওই চেষ্টা অন্যদের প্রেরণা দেবে বলেই মনে করছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা। সোনামুখীর ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রিয়কুমার সাহানা বলেন, “সাবিত্রী খুবই সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। আমরা ওঁকে খুব ভরসা করি।”

ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সাপে কাটলে ঝাড়ফুঁক না করিয়ে, আমরা আগে হাসপাতালে নিয়ে যেতে প্রচার চালাচ্ছি। সাবিত্রীর মতো সব চিকিৎসক এগিয়ে এলে, বহু মানুষ বাঁচবেন। ওঝা, গুণীণের কাছে ছোটাও বন্ধ হবে।’’ রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী ওই চিকিৎসককে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, ‘‘গ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে ভোল বদলাচ্ছে, এই ঘটনা তারই প্রমাণ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE