Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
পিছু ধাওয়া করে ধরল পুলিশ, উদ্ধার চোরাই কাঠও

চন্দন-কাণ্ডে জালে যাযাবর দল

ঠিক যেন কোনও ফিল্মের শ্যুটিং। চন্দন চোরেদের গাড়ি সাঁই সাঁই পালাচ্ছে। পিছনে ধাওয়া করেছে পুলিশের গাড়ি। সোমবার দুপুরের ঘটনা। অবশেষে মানবাজার ও পুঞ্চা থানার সীমানায়, কংসাবতী নদীর পায়রাচালি ঘাটের কাছে চোর বাবাজিরা ধরা পড়ল। যাযাবর সম্প্রদায়ের ছয় পুরুষ এবং তিন মহিলা আপাতত পুলিশের কব্জায়। পুলিশের দাবি, ধৃতদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে চন্দন গাছের টুকরো, কুড়ুল, দড়ি, করাত, রুপোর গহনা এবং কয়েক হাজার টাকা।

উদ্ধার হওয়া চোরাই জিনিসপত্র। —নিজস্ব চিত্র

উদ্ধার হওয়া চোরাই জিনিসপত্র। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
মানবাজার ও পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৬ ০১:৩৫
Share: Save:

ঠিক যেন কোনও ফিল্মের শ্যুটিং। চন্দন চোরেদের গাড়ি সাঁই সাঁই পালাচ্ছে। পিছনে ধাওয়া করেছে পুলিশের গাড়ি।

সোমবার দুপুরের ঘটনা। অবশেষে মানবাজার ও পুঞ্চা থানার সীমানায়, কংসাবতী নদীর পায়রাচালি ঘাটের কাছে চোর বাবাজিরা ধরা পড়ল। যাযাবর সম্প্রদায়ের ছয় পুরুষ এবং তিন মহিলা আপাতত পুলিশের কব্জায়। পুলিশের দাবি, ধৃতদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে চন্দন গাছের টুকরো, কুড়ুল, দড়ি, করাত, রুপোর গহনা এবং কয়েক হাজার টাকা।

পুলিশের দাবি, জেলায় চন্দন গাছ চুরির পিছনে একটি চক্র রীতিমতো সক্রিয়। সেই চক্রের দু’জনকেই আলাদা ভাবে গ্রেফতার করেছে মানবাজার ও পুরুলিয়া মফস্সল থানার পুলিশ। ওই দু’জনই বাঁকুড়ার ওন্দা থানার পুনিশোল গ্রামের বাসিন্দা। জেলার পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার বলেন, ‘‘নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতেই ওই দু’জনকে ধরা হয়েছে। তাদের জেরা করে চোরাই চক্রের বাকিদের নাম জানার চেষ্টা চলছে।’’

বেশ কিছুদিন ধরেই পুরুলিয়ার নানা প্রান্ত থেকে রাতের অন্ধকারে বেমালুম হাওয়া হয়ে যাচ্ছে দামি চন্দনগাছ। তা সে গৃহস্থের বাড়ি থেকেই হোক বা বন দফতরের চৌহদ্দি। হুড়া থানার লধুড়কা, বাউরিডি, কাশীপুর থানার কল্লোলী এলাকায় সম্প্রতি একাধিক বাড়ি থেকে আস্ত চন্দনগাছ সাবাড় করে দেয় চন্দন চোরের দল। এই ঘটনার কয়েক দিন পরেই পুরুলিয়া শহরে কংসাবতী (উত্তর) বন বিভাগের সদর দফতরের চৌহদ্দি থেকে একটি চন্দন গাছ কেটে নিয়ে পালিয়ে যায় চোরের দল। তার পরে অযোধ্যা পাহাড়ে বন দফতরের অফিস চত্বর থেকে ফের তিনটি চন্দন গাছ কেটে ফেলা হয়। গত ২৪ মে রাতে মানবাজার থানার ঝাড়বাগদা গ্রামের এক বাসিন্দার খামার বাড়ি থেকে একটি পরিণত চন্দন গাছ চুরি হয়।

সোমবারই জানা গিয়েছে, জেলার অন্য প্রান্তে বাঘমুণ্ডিতে সেচ দফতরের চৌহদ্দি থেকে দু’টি চন্দন গাছ কেটে ফেলেছে চোরের দল। সেচ দফতরের এগ্‌জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার মানস খাঁ জানিয়েছেন, দু’টি চন্দনগাছ চুরি গিয়েছে। আরও একটি কেটে ফেলেও নিয়ে যেতে পারেনি দুষ্কৃতীরা।

জেলা জুড়ে এ ভাবে পরের পর চন্দন গাছ সাবাড় হতে থাকায় মাথাব্যথা বাড়ছিল পুলিশের। ঝাড়বাগদার চুরির ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ প্রথম সাফল্য পায়। শুক্রবার গ্রেফতার করায় হয় পুনিশোলের বাসিন্দা গোলাম হোসেন মোল্লাকে। পুলিশের দাবি, ধৃত যুবক চুরির কথা স্বীকার করে। তাকে জেরা করে পুলিশ ওই চুরি-চক্রের আরও চার পাঁচ জনের নাম পায়। পুলিশ শনিবার তাকে তিন দিনের পুলিশ হেফাজতে নেয়। শনিবারই চন্দন গাছ চোরাই চক্রের আর এক পান্ডা শেখ লুড়ু ওরফে ফৈজুদ্দিন খানকে পাকড়াও করে মফস্সল থানা। রবিবার ধৃতের সাত দিনের পুলিশ হেফাজত হয়েছে। ফৈজুদ্দিনের বাড়িও ওন্দার পুনিশোলে। ফলে, গোলাম হোসেন ও ফৈজুদ্দিন একই চক্রে যুক্ত কিনা, তা পুলিশ খতিয়ে দেখছে।

জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘বিভিন্ন ঘটনার তদন্তে নেমে আমারা দেখেছি, চন্দন গাছগুলি চুরির ধরন মোটামুটি এক। বোঝাই যাচ্ছে, কোনও একটি নির্দিষ্ট চক্র এই কাণ্ড ঘটাচ্ছে। জেলায় কোথায় কেথায় চন্দনগাছ আছে, তা জানতে এই চক্র রীতিমতো হোমওয়ার্ক করেছে। ওই দু’জনকে জেরা করে চক্র সম্পর্কে আরও তথ্য জানা যাবে বলেই আমাদের আশা।’’

এ দিন অবশ্য বোঝা গিয়েছে, শুধুই কোনও চক্র নয়, যাযাবরদের একাংশও চন্দন চুরিতে হাত পাকিয়েছে। সোমবার সকালেই মানবাজার থানায় খবর আসে, পোদ্দারপাড়ার বাসিন্দা ব্যবসায়ী শঙ্কর দত্ত এবং একটি বেসরকারি স্কুলের প্রধানশিক্ষক আদিত্য সিংহ মহাপাত্রের খামার বাড়ি থেকে চন্দন গাছ চুরি হয়েছে। শঙ্করবাবুর ভাইপো অরুণাভ দত্ত বলেন, ‘‘সকালে খামার বাড়িতে এসে দেখি, দু’টো গাছ গোড়া থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে। একটা গাছের গোড়ার অংশ কেটে বাকিটা ফেলে দিয়ে গেছে চোরের দল।’’ আদিত্যবাবুর কথায়, ‘‘রবিবার রাতে আমার খামার বাড়িতে ঢুকেছিল চন্দন চোরেরা। পাঁচিলের গায়ে কাচের টুকরো ভেঙে কাঁটাতার কেটে ভিতরে ঢুকেছিল। তবে কাটার পর গাছটি পাশের খামার বাড়িতে পড়ে গিয়েছে। সম্ভবত আশপাশের লোকজন জেগে ওঠায় ওই গাছ আর তুলে নিয়ে যেতে পারেনি।’’

এ দিনই একটু বেলার দিকে ফের খবর মেলে, লাগোয়া বোরো থানার চন্দনপুর হাইস্কুল চত্বরে থাকা একটি পরিণত চন্দন গাছ চুরি হয়েছে। বোরো থানার পুলিশ তদন্তে গেলে বাসিন্দারা জানান, রবিবার এলাকায় যাযাবর সম্প্রদায়ের কিছু পুরুষ-মহিলাকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। পুলিশ এই সূত্র ধরে এগোয়। মানবাজার থানাকেও জানানো হয়। সূত্র মারফত পুলিশ জানতে পারে, দিন দুয়েক আগেই ৮-৯ জনের একটি যাযাবর দল মানবাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছে। এ দিন দুপুরে তারা একটি গাড়ি ভাড়া করে বাঁকুড়ার হাতিরামপুর যাওয়ার তোড়জোড় করছে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনী বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখে পাখি হাওয়া! হতোদ্যোম না হয়ে মানবাজারের সিআই সুবীর কর্মকা, ওসি শেখর মিত্র একটি গাড়িতে এবং অন্যটিতে বোরো থানার ওসি অমিত মাসান্ত বাহিনী নিয়ে রওনা হন। একই সঙ্গে পুঞ্চার ওসি শেখ ইসমাইল আলিকে পুঞ্চা থানার হাতিরামপুর যাওয়ার রাস্তায় পুলিশ নিয়ে অপেক্ষা করতে বলে দেওয়া হয়। শেষ অবধি পুলিশের জালে পড়ে ওই যাযাবরেরা। পুলিশ জানিয়েছে, ধৃতেরা সকলেই মধ্যপ্রদেশের বাসিন্দা। তাদের নাম ঠিকানা যাচাই করা হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gypsy group Stolen Sandalwood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE