ফোনের রিসিভার নামিয়েই গায়েব অনুসন্ধান অফিসের কর্মী।
সন্ধে ৬টা। চায়ের স্টলগুলির সামনে তুমুল ভিড়। কে আগে চা পাবেন, তা নিয়েই বচসায় জড়িয়ে পড়লেন দুই ক্রেতা। জিআরপি-র এক কর্মী এসে ধমক দিতেই দু’জনেই সুড়সুড় করে কেটে পড়লেন।
প্রায় একই সময়ে বর্ধমানগামী বড়হড়ওয়া প্যাসেঞ্জার চার নম্বর এবং হাওড়াগামী সিউড়ি হাওড়া এক্সপ্রেস তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে থেমেছে। চা স্টলের দু’পাশের ভিড় ঠেলে যাত্রীরা কোনও রকমে এগিয়ে চলেছেন। যাত্রীদের অনেকেই চোখেমুখে বিরক্তি প্রকাশ করছেন। কিন্তু কেউ-ই প্রতিবাদে মুখ খুলছেন না। কারণ চায়ের দোকানে ভিড় করা জটলার অধিকাংশই স্থানীয় বাসিন্দা। তাই জিআরপি বা আরপিএফ-ও তাঁদের খুব একটা ঘাঁটায় না।
রাত ৭টা। স্টেশনের মাইকে ঘোষণা শুরু হল— ‘মালদাগামী ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসবে। একই সঙ্গে সতর্ক ঘোষণা— কেউ নীচ দিয়ে লাইন পারাপার করবেন না, দরকারে ফুটব্রিজ ব্যবহার করুন’। তখনই দেখা গেল উল্টো দিকের ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে চার বন্ধু গল্পে মশগুল। কিছুক্ষণ পরেই ঘোষণা হল, ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। তখনও গল্প করে যাচ্ছেন তাঁরা। হঠাৎ-ই হুঁশ ফিরল। ট্রেন ঢুকতে দেখে চার জনেই টপাটপ ২ নম্বর লাইনে নেমে পড়লেন। সেখান থেকেই বিপজ্জনক ভাবে চড়লেন ট্রেনে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘কী অবস্থা দেখুন! তবু এঁদের কিছু বলা যাবে না। কিছু বলতে গেলেই দাদারা সব চলে আসবেন। কিছু হয়ে গেলেই তখন সব দোষ আমাদের।’’
রাত পৌনে ৮টা। ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে রাঁচিগামী বনাঞ্চল এক্সপ্রেস ঢুকল। শুরু হয়ে গেল হকারদের হুড়োহুড়ি। কোনও কিছু মানা নেই। ডিম টোস্ট, ঘুগনি, পুরি, ঝাল মুড়ি নিয়ে ছুটোছুটি চলছেই। ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে হকারের ধাক্কায় পড়তে পড়তে কোনও রকমে নিজেকে সামলে নিলেন এক যাত্রী। তিনি কিছু বলার আগেই সেই হকার বলে উঠলেন, ‘‘দেখতে পাচ্ছেন না?’’ যাত্রীদের সতর্ক করে মাইকে তখন বারবার ঘোষণা করা হচ্ছে— ‘অপরিচিত কারও দেওয়া খাবার বা কোনও পানীয় খাবেন না’। প্ল্যাটফর্মের উত্তর দিকে জিআরপি-র ওসি অপু দাস-সহ পুলিশ কর্মীদের দেখা গেল ট্রেন যাত্রীদের বলছেন, ‘‘কোথাও কিছু হলে ১৫১২ নম্বরে ফোন করবেন। এটা জিআরপি-র হেল্পলাইন।’’ ঠিক একই ছবি দেখা গেল প্ল্যাটফর্মের দক্ষিণ দিকে। আরপিএফ ইনস্পেক্টর সুজিৎ কুমার সদলবলে যাত্রীদের আরপিএফ-এর হেল্পলাইন নম্বর ১৮২ জানিয়ে বলছেন, ‘‘কিছু হলে এই নম্বরে ফোন করবেন।’’ কিন্তু কেউ-ই হকারদের কিছু বলছেন না। যাত্রীদের কথায়, ‘‘ওদের কিছু বলা যাবে না। ওদের ইউনিয়ন আছে।’’
রাত ৯টা। টিকিট কাউন্টারের সামনের বারান্দায় বহু পুরুষ ও মহিলা লাইন দিয়ে শুয়ে পড়েছেন। এ সময়ই হাওড়া থেকে আসা জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন বিশ্বভারতী সাঁইথিয়া স্টেশন ছেড়ে রামপুরহাটের দিকে রওনা দেয়। সেই ট্রেন চলে যাওয়ার পরে স্টেশন চত্বরে সমাজবিরোধীদের আনাগোনা শুরু হল। স্টেশনের উত্তরে রেললাইনের আশপাশে মদ, গাঁজা ও জুয়োর একাধিক ঠেক বসতে দেখা গেল। একই ছবি জিআরপি থানা এবং আরপিএফ অফিসের পিছন দিকের রেলমাঠ সংলগ্ন এলাকাতেও। চলল অনেক রাত পর্যন্তই।
রাতের দিকে বহু দূরপাল্লার ট্রেনের স্টপ না থাকায় সমস্যা পড়েন বাসিন্দারা।
রাত ১১টা থেকে ২টো পর্যন্ত একাধিক এক্সপ্রেস ট্রেন এল স্টেশনে। কিন্তু যাত্রী তেমন ওঠানামো করলেন না। ব্যস্ত স্টেশন কার্যত সুনসান হয়ে রইল। ট্রেন যাত্রী, গুটি কয়েক রেলকর্মী, জিআরপি ও আরপিএফ কর্মীদের ছাড়া তেমন কারও দেখাও মিলল না। তবে অত রাতেও চায়ের স্টলে তখনও দু’চারজন স্থানীয় যুবককে ঠিক দেখা গেল।
সন্ধে থেকে রাত, এই গোটা সময়পর্বে সাঁইথিয়া স্টেশন চত্বর ঘুরে জিআরপি ও আরপিএফ কর্মীদের আগের চেয়ে তুলনায় সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেল। রাতে হাওড়াগামী জামালপুর এক্সপ্রেস ধরতে স্টেশনে আসা স্থানীয় ব্যবসায়ী কিসান অগ্রবাল, উমা জয়সবালরা বললেন, ‘‘পুলিশ-প্রশাসন সক্রিয় হওয়ায় আগের চেয়ে অনেক নিরাপদ বোধ করি। তবে স্টেশনের দুই শেষ প্রান্তে ও বাইরে টিকিট কাউন্টারের দিকে আর একটু নজর দিলে ভাল হয়।’’ জিআরপি-র ওসি অপু দাস বলেন, ‘‘কর্মীরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেন। অপরাধ বা দুর্ঘটনা এড়াতে সারা রাত নজরদারি চালানো হয়।’’ আরপিএফ ইন্সপেক্টর সুজিৎ কুমারের দাবি, স্টেশন ছাড়াও মালগাড়ি, ট্রেন এবং আশপাশ এলাকায় নজর রাখা হয়।.
ছবি: অনির্বাণ সেন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy