প্রতীকী চিত্র।
মন্দিরের মূল ফটকে পড়ছে নতুন রঙের প্রলেপ। নাটমন্দিরের ঠিক বাঁদিকের ফাঁকা জায়গায় তৈরি হচ্ছে বাঁশ-কাপড় ত্রিপল দিয়ে মণ্ডপ। বাইরে মেলার দোকানপাট বসানোর কাজ চলছে পুরো দমে। চরম ব্যস্ত বড়রা। অন্যদিকে-কতদূর হল, সেটা খতিয়ে দেখতে কচিকাঁচারা খোঁজ চলাচ্ছে বারবার। খয়রাশোলের ময়নাডালের শতাব্দী প্রাচীন গৌরাঙ্গ মন্দির ঘিরে রবিবার নজরে পড়ল, ব্যস্ততার এমনই ছবি। ব্যস্ততা শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্ঠমী পালনের।
বিধি মেনে মাধ্যরাত্রিতে শ্রীকৃষ্ণ জন্মতিথি পালন থেকে শুরু করে পরের দিন নন্দ উৎসব সবটা মিলে এক হৈ হৈ কাণ্ড। বলছেন, গৌরাঙ্গ মন্দিরের সেবাইত মিত্রঠাকুর পরিবারের সদস্য প্রাণগোরা মিত্র ঠাকুর, নির্মলেন্দু মিত্রঠাকুর, উজ্জ্বল মিত্রঠাকুররা। তাঁদের কথায়, জেলার একমাত্র গৌরাঙ্গপীঠ এবং কীর্তনের মনোহরশাহী ঘরানার পীঠস্থান ময়নাডালে শতাব্দী প্রাচীন এই উৎসবের মেজাজটাই আলাদা। প্রচুর লোক সমাগম হয়। যদিও সোমবার নয়, বৈষ্ণব মতে মঙ্গলবার পালিত হবে শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্ঠমী। চলছিল তারই প্রস্তুতি।
গৌরাঙ্গপীঠ ও বৈষ্ণবক্ষেত্র ময়নাডালে জন্মাষ্ঠমী পলনের পিছনে অন্য ভাবনাও রয়েছে। গৌরাঙ্গ মন্দির যাঁর প্রতিষ্ঠিত, মিত্রঠাকুর পরিবারের সেই আদিপুরুষ তথা কীর্তনের মনোহরশাহী ঘরানার স্রষ্টা নৃসিংহ বল্লভ মিত্রঠাকুরের তিরোধান হয়েছিল এই সময়েই। কাটোয়ায় কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পরে চৈতন্যদেব এসেছিলেন রাঢ় বঙ্গে। পথক্লান্ত চৈতন্যদেব তাঁদের গ্রামের যুগ্ম নিম-তমাল গাছের নীচে বিশ্রাম নিয়েছিলেন এমনটাই বিশ্বাস করেন সিউড়ি ১ ব্লকের পানুরিয়া গ্রামের মানুষ। একই বিশ্বাস ময়নাডালের মিত্রঠাকুর পরিবারের।
ঠিক কোন পথে কাটোয়া থেকে বীরভূমে এসেছিলেন চৈতন্যদেব তার ইতিহাস নির্ভর তথ্য মেলা না। তবে লোকশ্রুতির মান্যতা মেলে বৃন্দাবন দাস ঠাকুরের ‘চৈতন্যভাগবত’-এ। তাতে উল্লেখ রয়েছে, বক্রেশ্বর থেকে চার ক্রোশ আগে নির্জন কোথাও সপার্ষদ বিশ্রাম নিয়েছিলেন পথক্লান্ত চৈতন্যদেব। তবে কোনও কোনও গ্রন্থে মেলে, চারশো বছরের বেশি সময় আগে বর্ধমানের কান্দরা থেকে জঙ্গল ঘেরা ময়নাডালে আসেন চৈতন্যভক্ত নৃসিহংবল্লভ। সাহিত্যরত্ন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ‘বাংলার কীর্তন ও কীর্তনীয়া’ গ্রন্থে সে উল্লেখ রয়েছে।
মিত্রঠাকুর পরিবারের ইতিহাস বলছে, চৈতন্যদেবের পার্ষদ গদাধর ঠাকুরের শিষ্য বর্ধমানের কান্দরার মঙ্গলঠাকুর। তাঁরই দীক্ষিত শিষ্য নৃসিহংবল্লভ। ১৬০০ খ্রীষ্ঠাব্দের আগে তিনি, মঙ্গলঠাকুরের পৌত্র বদনঠাকুর, শ্রীখণ্ডের রঘুনন্দন এবং বিখ্যাত পদকর্তা জ্ঞানদাস খেতুরী (অধুনা বাংলাদেশ) গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে সকলে মিলিত ভাবে কীর্তনের একটি ভিন্ন ধারার প্রচলন করেন। সেটাই মনোহরশাহী ঘরানা। এরপরেই নৃসিংহবল্লভ চলে আসেন ময়নাডালে। এবং বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। চলতে থাকে কীর্তন-চর্চা।
হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ‘‘ময়নাডাল রাঢ়ের অন্যতম বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ। সেখানে কীর্তন ও মৃদঙ্গের চতুষ্পাঠী ছিল।... ময়নাজালের মিত্রঠাকুরগণ বিদ্যাদানের সঙ্গে অন্নদানেও অকৃপণ ছিলেন।’’ মিত্রঠাকুররা জানাচ্ছেন, এখনও তন্তত পাঁচজন পেশাদার কীর্তনীয়া রয়েছেন ওই পরিবারে। কৃষ্ণজন্মজয়ন্তী উপলক্ষে পরিবারের ঐতিহ্যকে ফিরে দেখার সুযোগ থাকায় এই সময়ে কেউ বাইরে থাকেন না। নন্দ উৎসবে গাওয়া হয় পরিবারের আদিপুরুষের রচিত বিশেষ পদ। কাদা মাটির উপর সেই পদ গাইতে গাইতে চলে উৎসব। যোগ দেন ছেলে বুড়ো সকলেই। বংশ পরম্পরায় সেই ঐতিহ্যকে বহন করে আসছেন পরবর্তী পর্জন্ম। মিত্রঠাকুররা এখন প্রায় ৫০ ঘর।
‘‘এই উৎসবে মাততে মুখিয়ে থাকি সকলে’’, বলছেন বাবলি, অপর্ণা মিত্রঠাকুররা। বছরের সেরা আকর্ষণ, কলেজপড়ুয়া গার্গী ও সম্রাট মিত্রঠাকুরদের কাছে। আর পড়াশুনায় তিনদিনের ছেদ, গানবাজনা, মেলা, খাওয়াদাওয়া নিয়ে দেদার আনন্দ করার সুযোগ পেয়ে উচ্ছ্বসিত স্কুল পড়ুয়া উদ্দীপ, উৎসব মিত্রঠাকুররা। তারা বলছে, ‘‘খুব মজা করি আমরা।’’ ফি বছর ‘সংকীর্তন’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। এ বারও সেটা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy