Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
মুখে ‘অশান্তি নেই’, পিছনে অন্য কথা

সন্ত্রাস কবলিত নানুরে নামল এক কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী

দূর থেকে খেয়াল রাখছিল বেশির ভাগ চোখ। বাকি রাস্তার ধারে ইতিউতি মাথা বের করেই সেধিয়ে যাচ্ছিল ঘরের ভিতরে। জওয়ানেরা এগিয়ে গেলেও কথা বলতে এগিয়ে এলেন না কেউ। যে দু’চার জন কথা বললেন, প্রত্যেকের মুখেই সেই এক অভিব্যক্তি— ‘কোথাও কোনও সমস্যা নেই’।

নানুরের গ্রামে জওয়ানরা কথা বলছেন স্থানীয়দের সঙ্গে। নিজস্ব চিত্র।

নানুরের গ্রামে জওয়ানরা কথা বলছেন স্থানীয়দের সঙ্গে। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নানুর শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৬ ০৪:০০
Share: Save:

দূর থেকে খেয়াল রাখছিল বেশির ভাগ চোখ। বাকি রাস্তার ধারে ইতিউতি মাথা বের করেই সেধিয়ে যাচ্ছিল ঘরের ভিতরে। জওয়ানেরা এগিয়ে গেলেও কথা বলতে এগিয়ে এলেন না কেউ। যে দু’চার জন কথা বললেন, প্রত্যেকের মুখেই সেই এক অভিব্যক্তি— ‘কোথাও কোনও সমস্যা নেই’।

মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় বাহিনী পা রাখতেই এমনই ছবি ধরা পড়ল দেখা মিলল রাজনৈতিক সন্ত্রাস কবলিত নানুর এলাকায়। যা দেখে বিরোধীরা দাবি করছেন, এই আপাত ‘শান্তি’র পিছনে রয়েছে অন্য ‘গল্প’। শাসকদলের চাপেই কেউ প্রাণের কথা খুলে বলতে সাহস পাচ্ছেন না নানুরে। অভিযোগ, সব সময়ই বাসিন্দাদের উপরে নজর রাখছে স্থানীয় কিছু পরিচিত রাজনৈতিক মুখ। তৃণমূল অবশ্য সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। গোটা বিষয়টিকেই বিরোধীদের অপপ্রচার বলে দাবি তৃণমূল নেতৃত্বের।

ঘটনা হল, বিভিন্ন নির্বাচন উপলক্ষে নানুরে পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের দাবি দীর্ঘ দিনের। কারণ ওই এলাকায় সন্ত্রাসের আবহ বহু পুরনো। একসময়ে ওই দাবিতে সরব হতে শোনা গিয়েছে বর্তমান শাসকদল তৃণমূলকেই। সে সময় তৎকালীন শাসকদল সিপিএমের বিরুদ্ধেই ভোট লুটের অভিযোগ উঠত। আর তাই নিয়ে দু’পক্ষের গোলাগুলির লড়াইয়ে তেতে উঠত গ্রামের পর গ্রাম। গত বিধানসভা ভোটের পর থেকেই ছবিটা পাল্টে যায়। বুথ দখলের অভিযোগে সরব হন বামেরা। কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকা সত্ত্বেও গত লোকসভা ভোটে নানুরের বহু বুথে বিরোধীদের কোনও এজেন্টকেই বসতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। এমনকী, পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলাও পরিষদের একটি আসন ছাড়া বিরোধীরা কোনও প্রার্থীই দিতে পারেননি। তাই সন্ত্রাসের আশঙ্কায় আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগের দাবি তুলেছিলেন বিরোধীরা।

তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল, এ বার নানুরে শুধু বিরোধীরাই নয়, সন্ত্রাসের আশংকা রয়েছে তৃণমূলেরও। কারণ গত কয়েক মাস ধরেই এলাকার বিদায়ী তৃণমূল বিধায়ক গদাধর হাজরার অনুগামীদের সঙ্গে এলাকার দাপুটেনা তৃণমূল নেতা কাজল শেখের গোষ্ঠী-সঙ্ঘাত চরমে উঠেছে। গোলাগুলির পাশাপাশি খুন কিংবা খুনের চেষ্টা, প্রায় নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে নানুরে। তৃণমূলেরই একাংশের মতে, গদাধর হাজরার প্রার্থিপদ কাজলের না পছন্দের ছিল। তাঁর কোনও অনুগামী কিংবা বহিরাগত কাউকে প্রার্থী হিসাবে চেয়েছিলেন কাজল। কিন্তু গদাধরকেই ফের প্রার্থী করেছে দল। স্বাভাবিক ভাবেই ‘অর্ন্তঘাতে’র আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না দলের নেতারাই। তাই বিরোধীদের সঙ্গে তো বটেই, গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের প্রভাবও নির্বাচনে পড়তে পারে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। কাজল অবশ্য জানিয়েছেন, তিনি দলের সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নেবেন। গদাধরের বক্তব্য, ব্যক্তি কোনও ফ্যাক্টর নয়, উন্নয়নের জন্য মানুষ তাঁকেই জেতাবেন।

এ দিনই ভোরে নানুরে পৌঁছয় এক কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। স্থানীয় কিসান মান্ডি ঘাঁটি গাড়েন তারা। এলাকায় পা রেখেই বেলা ১১টা নাগাদ তারা নানুরের বিভিন্ন গ্রামে রুটমার্চ শুরু করে দেয়। জওয়ানদের পথ দেখান নানুর থানার ওসি পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়। ২৬ জনের ওই দলটি স্থানীয় বেলুটি, মোহনপুর, চণ্ডীপুর, সাওতা গ্রামে রুটমার্চ করে। একসময়ে গ্রামগুলিতে তৃণমূলের অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। মূলত শরিকদের সঙ্গেই সঙ্ঘাত হতো সিপিএমের। ওই সব শরিকদের বড় অংশই এখন তৃণমূলে। কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সিপিএমও। বামেদের শরিকি সঙ্ঘাত এখন রূপ নিয়েছে তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দলে। তবে কেন্দ্রীয় বাহিনীর কাছে অবশ্য তা খোলসা করেননি কেউ। বাহিনীর জওয়ানেরা চণ্ডীপুরের জরিনা বিবি, হাসেম শেখদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের ভোটের জন্য কেউ হুমকি দিচ্ছে কিনা, কোনও ভয় আছে কিনা জানতে চান তাঁরা। কোনও সমস্যা হলে প্রশাসনকে জানানোর পরামর্শও দেন ওই জওয়ানেরা। জওয়ানদের কথা শেষ হতে না হতেই ওই সব গ্রামবাসী মাথা নেড়ে জানিয়ে দেন, তাঁদের কোনও ‘সমস্যা’ই নেই। যদিও তাঁদের চোখেমুখের অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছিল যেন শিখিয়ে দেওয়া বুলি আউড়াচ্ছেন তাঁরা।

ঘটনা হল, পরে সংবাদমাধ্যমের কাছে এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্যই করতে চাননি জরিনা বিবিরা। যা সন্দেহ আরও বাড়িয়েছে। এ দিকে নিজেদের তৃণমূল সমর্থক হিসাবে দাবি করে বেশ কিছু গ্রামবাসী দাবি করছেন, ‘‘আমাদের হয়েছে উভয় সঙ্কট। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। ভোট দিতে গেলে কাজলের ক্ষোভের মুখে পড়তে হতে পারে। আবার না দিতে গেলে বিধায়কের কাছে কাজলের লোক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যেতে হবে!’’ অন্য দিকে, বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকেরা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপর আর কত দিন ভরসা করে থাকা যাবে। শাসকদলের নেতারা প্রকাশ্যেই হুমকি দিতে শুরু করেছেন বলে তাঁদের অভিযোগ।

স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আনন্দ ভট্টাচার্যের অভিযোগ, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী এসেছে ভাল কথা। কিন্তু ভোট না পেরনো পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না। কারণ লোকসভায় ওদের বসিয়ে রেখে তৃণমূল ছাপ্পা দিয়েছিল।’’ তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল অবশ্য পাল্টা দাবি করেছেন, সব অভিযোগই ভিত্তিহীন। উন্নয়নের নিরিখে মানুষ তাঁদের জেতাবেন বলেই তাঁর আশা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE