সাঁইথিয়ার শিবিরে চলছে কৃত্রিম অঙ্গ বানানো। ছবি: অনির্বাণ সেন।
তিন বছর বয়সে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে, পোলিওতে ডান পা হারিয়েছিলেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ডায়মন্ড হারবার মহকুমার রামনগরের ত্রিদীপ্ত দাস। অফিস যাওয়ার পথে উত্তরপাড়া স্টেশনে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছিলেন বিহারের ছাপড়া জেলার শোনপুরের রাধেশ্যাম সাউ-ও। কিন্তু জীবনের দৌড়ে থেমে না থেকে, প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ত্রিদীপ্ত, রাধেশ্যামরাই প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। কলকাতার ‘মারোয়াড়ি সেবা সদনে’র কর্মী হিসাবে তাঁরা প্রতিবন্ধীদের কৃত্রিম অঙ্গ তৈরিকেই পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন।
সম্প্রতি সাঁইথিয়া হনুমান মন্দিরে ‘মারোয়াড়ি সেবা সমিতি’-র উদ্যোগে এবং কলকাতার ‘মারোয়াড়ি সেবা সদন’-এর সহযোগিতায় গত ১৯ মার্চ শুরু হয় একটি প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করণ শিবির। এই শিবিরে একইসঙ্গে প্রতিবন্ধীদের কৃত্রিম অঙ্গ প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। বৃহস্পতিবার ছিল শিবিরের শেষ দিন। সেখানে বসেই তাঁদের জীবনের কথা বলছিলেন ত্রিদীপ্তবাবু এবং রাধেশ্যামবাবু। বাইরে চিকিৎসা করতে এসে রোগীরাও শুনছিলেন জীবন-যুদ্ধের কাহিনি।
“বিহারের ছাপড়া জেলার শোনপুরে কেটেছে ছেলেবেলা। সেখানকার রাজেন্দ্রপ্রসাদ সিংহ কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও অঙ্ক নিয়ে স্নাতক হই। তারপর পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চলে আসি কলকাতায়।” বলছিলেন রাধেশ্যামবাবু। হিন্দমোটর কারখানায় তাঁর বাবা কাজ করতেন। সেখানেই তাঁরও একটা কাজ জুটে যায়। তিনি বলেন, “বেশ চলছিল, বালির হপ্তা পাড়ায়। কাজের ফাঁকে ভালো চাকরির খোঁজে পড়াশোনা করে নিজেকে তৈরি করছিলাম। হঠাৎ-ই একদিন উত্তরপাড়া স্টেশনে রেল অ্যাক্সিডেন্টে আমার একটা পা কাটা গেল!”
সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা চলে যায় রাধেশ্যামবাবুর। একদিন দেখা হয়ে যায় কলকাতার একবালপুরের ‘মারোয়াড়ি সেবা সদন’- এর স্টোর ইনচার্জ কর্মকর্তা স্বপন আচার্যের সঙ্গে। তিনি রাধেশ্যামকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তাঁদের অফিসে। রাধেশ্যামের জন্য জয়পুরের পা-এর ব্যবস্থা করে দেন। “পা লাগিয়ে আসার পর স্বপনবাবুকে বললাম একটা কাজের জন্য। উনি রাজস্থানের জয়পুরের মহাবীর বিকলাঙ্গ সমিতির ট্রেনিং সেন্টারে এই কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি করতে শেখার জন্য পাঠালেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি যেমন, অন্যদেরও আজ সাহায্য করতে পারছি।” ত্রিদীপ্তবাবু বলছিলেন তাঁর ছোটবেলার কথা।
এক পা হারিয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়া নিয়ে বলছিলেন, “আমিও প্রতিবন্ধী হয়ে গেলাম একদিন! কিন্ত আমার মা-বাবা হাল ছেড়ে দেননি। প্রতিনিয়ত তাঁরা যোগাযোগ করতে থাকেন বিভিন্ন ডাক্তারের সঙ্গে। চলতে থাকে আমার পড়াশোনাও। একদিন যোগাযোগ হল মারোয়াড়ি সেবা সদনের সঙ্গে।” মারোয়াড়ি সেবা সদনই ত্রিদীপ্তবাবুর পায়ের জন্য ‘ক্যালিবারের’ ব্যবস্থা করে দেয়। চিকিৎসা চলার সময় সেখানকার এক কর্মকর্তার কাছে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেবার কথা বলেন তিনি। স্মৃতি থেকে বলেন, “সেই দিদিরই চেষ্টায় ওই সংস্থা থেকে ট্রেনিং করলাম। প্রথমে টেলারিং, তারপর হ্যান্ডমেড ব্যাগ তৈরি। তারপর কম্পিউটার। তিন মাস ধরে কাজ শিখে এই সংস্থাতেই কাজে যোগ দিলাম।”
সাঁইথিয়া মারোয়াড়ি সেবা সমিতির উদ্যোগে যে শিবির হচ্ছে সেখানে একবালপুরের সেবা সদনের ছয় জনের একটি দল এসেছে। এই দলেরই ম্যানেজার স্বপন আচার্য ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এস ই সিংভি। তাঁরা জানালেন, রাধেশ্যাম বা ত্রিদীপ্তবাবুদের এই উদ্যোগে তাঁরা খুশি। তাঁদের সোসাইটিতে বেশ কিছু প্রতিবন্ধী কর্মী রয়েছেন। যারা নিজেদের প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে উঠে আরও দশ জন প্রতিবন্ধীর পাশে দাঁড়িয়েছেন।
সাঁইথিয়া মারোয়াড়ি সেবা সমিতির সম্পাদক রাজেশ নাহাটা ও সহ সম্পাদক বিজয় চৌধুরী বলেন, “২০১১ সালে কলকাতার মারোয়াড়ি সেবা সদনের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রথম বার এই শিবিরের আয়োজন করেছিলাম। প্রায় ১২৫ জনকে আমরা কৃত্রিম অঙ্গ দিতে পেরেছি। প্রতিবন্ধী ওই দু’জন যে ভাবে তাঁদের নিরলস প্রচেষ্টায় এত প্রতিবন্ধীর মুখে হাসি ফুটিয়ে দিল, তাকে কুর্নিশ জানাই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy