এ ভাবেই হয় শিকার। —নিজস্ব চিত্র।
ক’টা দিন আগের কথা। শীতের সকালে সিউড়ির কয়েক জন বড়লোক বন্ধু জমিয়ে খানাপিনার আয়োজন করছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক। খানাপিনায় যোগ দিতে না চাইলেও ওই বন্ধুদের অনুরোধে সৌজন্য দেখিয়ে দু’টুকরো মাংস চাখতে রাজি হয়েছিলেন। মুখে দিতেই লেগেছিল খটকা! এমন স্বাদের মাংস তো খাইনি— কীসের মাংস এটা?
প্রথমে কেউ কিছু না বলতে চাইলেও পরে এক জন ফিসফিস করে জানিয়েছিলেন ‘বারহেডেড গুজ’-এর মাংস। ১০০০ টাকায় কেনা। আর খেতে পারেননি তিনি! তাঁর কথায়, ‘‘গা-টা গুলিয়ে উঠেছিল। পাখিগুলো হাজার হাজার কিলোমিটার দূর থেকে উড়ে এসেছে। রসনা মেটাতে আমরা ওদেরও খেয়ে নিচ্ছি! ওরা যাবে কোথায়?’’
বিগত দেড় দশক ধরে বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জলাধার, নীলনির্জনে ছিল পরিযায়ীদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থল। শীত আসতেই সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে ওরা চলে আসে। কেউ আসে একটানা হাজার হাজার মাইল উড়ে। কাউকে পথ দেখায় রাতের তারা। কিন্তু, স্বস্তি কই?
এলাকার বাসিন্দারাই জানালেন, এখানে দেখা যেত বড়ি হাঁস (বার-হেডেড গুজ), ব্রাহ্মণী হাঁস (রুডি শেলডাক), খুন্তে হাঁস (সোভেলার) বা রাঙা মুড়ি হাঁস, কমন কুট, গ্রিব-সহ বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ীর। শুধু কি পরিযায়ী? সরাল, বালিহাঁস, নানা জাতের পানকৌরি, জলপিপি, জলময়ূরের মতো প্রচুর বাংলার পাখিও দেখা যেত। এখনও অনেকের দেখা মেলে। আর তাদের অপেক্ষায় যারা থাকে, সেই প্রকৃতিপ্রেমীদের অনেকেই জানালেন— এ বার কিছু কম এসেছে। একই সঙ্গে তাঁদের সংশয়, এ ভাবে পক্ষী নিধন চললে আর কত দিন ওদের দেখা মিলবে?
কী ভাবে চলে শিকার?
স্থানীয় সূত্রেই জানা গেল, জলাশয়জুড়ে বিছিয়ে রাখা হয়েছে ফাঁস জাল। জলের নীচে খাবারের জন্য ডুব দিতে গেলেই জালে আটকে যায় পাখিরা। এ ছাড়া ফাঁদি জাল, এয়ার গান দিয়েও চলছে শিকার।
নীলনির্জনে এক পাখি-শিকারির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তার হাতে তখন একটি মৃত একটি ‘গ্রেট ক্রেস্টেড গ্রিব’। বিরল দর্শন এই পরিযায়ীকে কী ভাবে মারা হল প্রশ্ন করতেই, মিলল উত্তর— ফাঁস জালে আটকে পড়েছিল। দাম কত? মাথা চুলকে পাখিশিকারির উত্তর— ওজন বেশি নয়, তাই দাম ২০০ টাকা। কী ভাবে বিক্রিবাটা, জানা গেল তা-ও। পাখি ধরা পড়লেই চলে যায় ফোন। পাখির প্রজাতি এবং আকার অনুযায়ী দাম হেরফের করে ২০০ থেকে ১০০০ টাকায়। বিক্রির বাজার ছাড়িয়ে রয়েছে সিউড়ি, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের উপনগরী, চিনপাই, দুবরাজপুর-সহ বিভিন্ন এলাকায়। শিক্ষিত, পয়সাওয়ালা এবং শৌখিন মানুষরাই যার ক্রেতা।
বোলপুরের প্রকৃতিপ্রেমী উর্মিলা গঙ্গোপাধ্যায় এমনটা দেখেশুনে ক্ষুব্ধ। বলছেন, ‘‘এমনিতেই বাংলার বিভিন্ন জলাশয়ে পাখিদের আসা কমেছে। বোলপুরে বল্লভপুরে জল নেই, তাই পাখি আসেনি। সিউড়িতে তিলপাড়া জলাধারে ফাঁস জালের প্রকোপে পাখিরা আসছে না। বাকি ছিল নীলনির্জন। যোগ হল না সেটাও।’’ বেশ কয়েক বছর ধরে নীলনির্জনে আসেন দক্ষিণ কলকাতার চিকিৎসক মিতা দত্ত ও সঙ্গীসাথীরা। গতবার পাখির দেখা না পেয়ে এ ভেবেছিলেন বিলম্বিত শীতই হয়তো দায়ী। এ বার এসে বুঝলেন, নাহ্ সেটা কারণ নয়।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০১ সালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার আগেই গোপালপুর মধুপা, ভোঁড়া, রাধামাধবপুরমণিরামপুর মতিজাপুর, মেটালা, গুণ্ডোবা-সহ বেশ কয়েক’টি গ্রামের মানুষের জমি অধিগ্রহণ করে গড়ে ওঠে ২৬৬৭ একরের জলাশয়টি। বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র জল ব্যবহার করলেও, এখনও সেচ দফতরের অধীনেই রয়েছে জলাধার। যেহেতু বন দফতরের দায়িত্বে জলাশয়টি নেই, তাই বন্যপ্রাণ হত্যার নজরদারি চালাতে অসুবিধা হয়, যুক্তি বন দফতরের কর্তাদের।
উপায়? ডিএফও কল্যাণ রাই বলছেন, ‘‘পাখি মারার খবর আগে কেউ দেয়নি। এমনটা হলে দেখব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy