Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ভরসা হারিয়ে গ্রাম ছাড়ছে বাজিতপুর

আর বর্ষা পেরোলেই কাজ শুরু করার আশ্বাস শুনছি। ওই আশ্বাস শুনতে শুনতেই কত বর্ষা পেরিয়ে গেল, নদীর পাড় আর বাঁধানো হল না।

ভাঙন: ময়ূরেশ্বরের বাজিতপুরে নদীগর্ভে ঘর-বাড়ি। নিজস্ব চিত্র

ভাঙন: ময়ূরেশ্বরের বাজিতপুরে নদীগর্ভে ঘর-বাড়ি। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

পাড় ভাঙতে ভাঙতে নদী পৌঁছে গিয়েছে বাড়ির দোরগোড়ায়। তবুও ঘুম ভাঙেনি প্রশাসনের। শুধু রাতের ঘুম উবে গিয়েছে গ্রামবাসীর। তাই প্রশাসনের প্রতি ভরসা হারিয়ে গ্রাম ছাড়ছেন বাজিতপুরের বাগদি পাড়ার বাসিন্দারা।

বছর কুড়ি আগেও ওই নদীর ধারে গ্রামের বাগদি পাড়ায় প্রায় ১০০টি পরিবারের বাস ছিল। সে সময় ওই পাড়া থেকে নদীর দূরত্ব ছিল ৫০ ফুটেরও বেশি। কিন্তু প্রতিবছর পাড় ভাঙতে ভাঙতে একের পর এক নদীর গ্রাসে তলিয়ে গিয়েছে অনেকের ঘর গেরস্থালি। ঘরবাড়ি হারিয়ে বহু পরিবার উঠে গিয়েছেন অন্য পাড়ায়। আবার গ্রাম ছেড়েই চলে গিয়েছেন অনেকে। বর্তমানে ওই পাড়ায় থাকেন মাত্র ২৫ পরিবার। কিন্তু তারাও রয়েছেন চরম আশংকায়। কারণ, ইতিমধ্যেই ওইসব পরিবার ঘরবাড়ি খুঁইয়ে কিছুটা সরে এসেছেন। আসলে ওই পাড়ার প্রান্ত ছুঁয়ে বয়ে গিয়েছে দ্বারকা নদী।

পাড় ভেঙে নদীও তাঁদের নতুন বাড়ির সঙ্গে দূরত্ব কমাতে কমাতে নিকটবর্তী হচ্ছে। এখন ওই পাড়ার সঙ্গে নদীর দূরত্ব মেরে কেটে ২০ ফুট। গ্রামবাসীদের দাবি, পাড় ভেঙে প্রতিবছর নদী ৪/৫ ফুট করে গ্রামমুখী হচ্ছে। সেই হিসাবে এখনই পাড় বাঁধানো না হলে আর মাত্র ৪/৫ বছরের মধ্যে গোটা পাড়াটাই নদীর গ্রাসে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। শুধু ওই পাড়াই নয়, লাগোয়া জরুল পুকুর ধরে ভাঙন পৌঁচ্ছে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে গ্রামের অন্যান্য প্রান্তেও। অথচ নদীর পাড় বাঁধানোর ব্যাপারে প্রশাসনের কোনও উদ্যোগই নেই বলে অভিযোগ। মানিক বাগদি, ক্ষুদিরাম বাগদিদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরেই আমরা প্রশাসনের সকলস্তরে নদীর পাড় বাঁধানোর দাবি জানিয়ে আসছি। আর বর্ষা পেরোলেই কাজ শুরু করার আশ্বাস শুনছি। ওই আশ্বাস শুনতে শুনতেই কত বর্ষা পেরিয়ে গেল, নদীর পাড় আর বাঁধানো হল না।

তাই প্রশাসনের প্রতি ভরসা হারিয়ে গ্রাম ছেড়ে ময়ূরেশ্বরের নারায়ণঘাটিতে উঠে গিয়েছেন শিশু বাগদি, মহুরাপুরে বাড়ি করেছেন প্রহ্লাদ বাগদির মতো বহু পরিবার। তাঁরা বলেন, ‘‘বাপ ঠাকুরদার ভিটে ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হয়েছিল। যে বাড়িতে আমার জন্মেছি, বড় হয়েছি, যে বাড়ি থেকে আমাদের পূর্বপুরুষেরা শেষ যাত্রায় গিয়েছেন সেই বাড়ির হাজারো স্মৃতিচিহ্ন ফেলে আসা যে কতটা কষ্টের তা আমারাই জানি। প্রশাসনের উদাসীনতায় আমাদের সব পিছনে ফেলে উঠে আসতে হয়েছে।’’ যারা পড়ে রয়েছেন তাঁরাও স্বস্তিতে নেই। বছর ৫/৭ আগে নদীর
গ্রাসে সব খুঁইয়ে কিছুটা সরে ফের বাড়ি করেছেন হরি বাগদি, গণেশ বাগদিরা। তাঁরা বলেন, ‘‘নদীর ভাঙনে পুরুষানুক্রমে ঘর ভাঙে আর আমরা পিছিয়ে পিছিয়ে আসি। নদীও ধেয়ে আসে। এ বার হয়তো আমাদেরও বাপ-ঠাকুরদার ভিটের মায়া ত্যাগ করতে হবে। আর তো আমাদের পিছোনোরও জায়গা নেই।’’

শুধু ঘরবাড়িই নয়, নদীর গ্রাসে তলিয়ে যেতে বসেছে শতাধিক বছরের প্রাচীন ভবতারিণীর মন্দিরও। ওই মন্দিরের সেবাইত অরুণানন্দ ব্রহ্মচারী, স্থানীয় বাসিন্দা দুলাল মুখোপাধ্যায়রা বলেন, ‘‘প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ কিংবা আষাঢ় মাসে দু’দিন ব্যাপী উৎসব হয় ওই মন্দিরে। দূর-দূরান্তের মানুষজন সেই উৎসবে যোগ দেন। তাই মন্দির ঘিরে তাদের ধর্মীয় ভাবাবেগ জড়িয়ে রয়েছে। প্রশাসনের উদাসীনতায় এ বার হয়তো তাঁদের সেই ভাবাবেগও নদী গর্ভে তলিয়ে যাবে।’’

কী বলছেন শাসক দলের জন প্রতিনিধিরা?

ময়ূরেশ্বর ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ধীরেন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওই পাড়ার বাসিন্দাদের অভিযোগ যথার্থ। বাম আমলেই বছরের পরে বছর গ্রামবাসীর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। আমরা ওই রকম কোনও প্রতিশ্রুতি দিইনি। বরং আমরা ক্ষমতায় আসার পরে নদী পাড় বাঁধানোর প্রস্তাব জেলা
পরিষদে পাঠিয়েছি। জেলা পরিষদও ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে।’’

জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘গ্রামের নদী বাঁধের প্রস্তাব অনুমোদিত
হয়েছে। আর্থিক সংস্থান হলেই দ্রুত কাজ শুরু হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

House Erosion River
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE